রাইজিংবিডি স্পেশাল

‘স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় ব্লেড দিয়ে পা কেটেছিলাম’

এসকে রেজা পারভেজ: একুশ আগস্টের ভয়ঙ্কর সেই গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়াদের মধ্যে একজন মাহবুবা পারভিন। স্প্লিন্টারবিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষেও তিনি প্রতিনিয়ত যন্ত্রণায় ভুগছেন। ঘটনার তিন বছর পরে একদিন যন্ত্রণা সইতে না পেরে নিজেই ব্লেড দিয়ে পা কেটে তা বের করেছিলেন। পরে ইনফেকশন হয়ে তার পা টাই হারাতে বসেছিলেন।    

মাহবুবা পারভিন রাইজিংবিডিকে যখন তার ভয়াল স্মৃতি বলছিলেন তখন তার চোখ মুখ ও কণ্ঠে পরিলক্ষিত হয় বেদনা-ক্ষোভ-যন্ত্রণা-আতঙ্কের মিশেল।

২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সেই সামবেশে যোগ দিতে সাভার থেকে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে এসেছিলেন তৎকালীন ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মাহবুবা পারভিন।

 

 

‘যখন সাভার থেকে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে এসে পৌঁছাই তখন ৪টা বাজে। আমি আইভি আপার (আইভি রহমান) পাশে পেছনের একটি ট্রাকের চাকার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। কারন সেখান থেকে নেত্রীকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিলো। শীর্ষ নেতারা একের পর এক বক্তব্য দিলেন। এরপর শেখ হাসিনা আপার বক্তব্যের প্রায় শেষভাগে জয় বাংলা বলার সাথে সাথে পুরো এলাকা বিকট শব্দে অন্ধকার হয়ে গেলো। শুধু চিৎকার আর চিৎকার। আমি দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে গেলাম। এরপর আর আমার কিছুই মনে নেই। অনেক পরে সুস্থ হবার পর জানতে পারলাম গ্রেনেড হামলায় আমি হার্ট অ্যাটাক করেছিলাম। আমাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য কাপড়ের ব্যানারে করে দুই পাশ থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। আমার এক সাইড প্যারালাইসড হয়ে গিয়েছিলো। বাম হাত, বাম পা অবশ হওয়ার কারনে আমাকে দাঁড় করাতে পারেছিলো না। স্বেচ্ছসেবক লীগের প্রচার সম্পাদক আশীষ কুমার মজুমদার আমাকে সেখান থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান। ৭২ ঘন্টা আইসিইউতে ছিলাম, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়েছি। আমার ভাই যখন ডাক্তারের কাছে আমার অবস্থা জানতে চাইলেন তখন ডাক্তার বলেছিলেন উনি বেঁচে আছে না কি মরে গেছে তা ৭২ ঘন্টা পর বোঝা যাবে। এ কথা শুনে আমার ভাই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।’-কথাগুলো একটানা বললেন মাহবুবা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ-ই তার কোন খোঁজ খবর নেননি বলে আক্ষেপ করেন মাহবুবা পারভিন।   

তার ভাষায়, ‘ওই হামলায় আমার নেত্রীর শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। অথচ তিনি নিজের কথা চিন্তা না করে আমাদের চিকিৎসা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, খোঁজ নিয়েছেন। আমার নেত্রী ছাড়া অন্য কেউই আমার খোঁজ খবর নেয় নি। আমি স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন নেতা। অথচ আমার সংগঠনের কেউ-ই আমার খোঁজ নেয়নি। বাংলাদেশে আমার স্মৃতি ফিরে আসেনি। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। পঁচিশ দিন পর আমার জ্ঞান ফেরে।’

 

 

গ্রেনেড হামলার পর শরীরে থেকে যাওয়া স্প্লিন্টার বছরের পর বছর অসহ্য যন্ত্রণা দিচ্ছিলো জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কলকাতায় যখন আমার জ্ঞান ফিরলো তখন থেকেই প্রতিদিন প্রতিক্ষণ যন্ত্রণা ভোগ করেছি। এমন কষ্ট যে চিৎকার করে কেঁদেছি। ঘটনার প্রায় তিন বছর পর একদিন আর সহ্য করতে পারছিলাম না। রাত ৩টার দিকে বাধ্য হয়ে নিজেই ব্লেড দিয়ে কেটে স্প্লিন্টার বের করতে চেয়েছিলাম। রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো সব। কিন্তু যন্ত্রণা আর ভেতরে যেভাবে কামড়াচ্ছিলো তার কাছে এই রক্ত কিছুই না। এ ঘটনার পর ক্ষত স্থানে ইনফেকশন হয়ে সেখানে পচন ধরে যায়। এক পর্যায়ে ডাক্তার পা কেটে ফেলতে হতে পারে বলেও জানান। সেই থেকে আজ অবদি গত ১৫ বছর একটি রাতেও ঠিকমত ঘুমাতে পারি না।’

একুশ আগস্টের রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর হত্যকারীদের বিচার হয়েছে। ২১ আগস্টের হত্যকারীদের বিচারের রায়ে আমি সন্তুষ্ঠ। আরও সন্তুষ্ট হতাম যদি তারেক রহমানের ফাঁসি হতো। আমার মনে হয়, দৃষ্টান্ত হিসেবে যদি তারেক রহমানের ফাঁসি দেয়া হত তাহলে এই ধরনের জগণ্য, বর্বর ঘটনা আর কেউ ঘটাতে সাহস পেতো না। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র বলে সে পার পেয়ে যাবে এটা ঠিক না।’

ভিডিও :

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ আগস্ট ২০১৯/রেজা/নবীন হোসেন/নাসিম