রাইজিংবিডি স্পেশাল

জোরদার হচ্ছে মানিলন্ডারিং-সন্ত্রাসে অর্থায়নে প্রতিরোধ কার্যক্রম

এম এ রহমান মাসুম : মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ কার্যক্রম আরো জোরদার করতে নতুন পরিকল্পনায় অগ্রসর হচ্ছে সরকার। দেশি-বিদেশি গোয়েন্দাদের নানা আশংকার তথ্য মাথায় রেখে বিষয়টিকে আরো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

এরই ধারাবাহিকতায় সন্ত্রাসে অর্থায়ন ও দেশের অর্থপাচার কীভাবে আরো শক্তভাবে দমন করা যায় সেই কর্মপন্থাও খুঁজছে সরকার। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই জরুরি সভা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্স।

এজন্য আগামি ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সভার মূল এজেন্ডা রাখা হয়েছে ‘মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ও দমন কার্যক্রম জোরদারকরণ’।

সপ্তমবারের মত আয়োজিত এ সভা বুধবার (আগামিকাল) বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ভবনে অনুষ্ঠিত হবে। সভার এজেন্ডা বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের ২২ সংস্থার কাছে কর্মপন্থা ও প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে বেশ আগেই। সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার তিনদিন আগে তা দেয়ার জন্য বলা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিভিন্ন সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

বিভিন্ন সংস্থাকে দেয়া চিঠির সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের সপ্তম সভায় সভাপতিত্ব করবেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রধান আবু হেন মোহা. রাজী হাসান। সভায় ২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর গঠিত কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের সদস্যদের উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে এনবিআরের সদস্য (শুল্কনীতি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের চিঠি পেয়েছি। আমাদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেবে। সভায় নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সংস্থাটি। সভার মূল এজেন্ডা সম্পর্কে তারা ভালো বলতে পারবে। আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না।’

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মূদ্রা পাচার ও অবৈধ অর্থ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার প্রতিরোধ ও দমনে যথেষ্ট আইন রয়েছে।  কোন সংস্থার কি দায়িত্ব তা নির্ধারণ করে দেয়াও আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ সে ভাবে হচ্ছে না। আর এ কারণেই আর্থিক খাতে এত বড় জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। আমরা সবাই চাই অপরাধীরা আইনের আওতায় আসুক।  দেশের টাকা দেশে বিনিয়োগ হোক। দেশের নিরাপত্তা অক্ষুন্ন থাকুক।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার বেড়েছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় ৫৯০ কোটি ডলার (৫০ হাজার কোটি টাকা) পাচার হয়েছে। জিএফআই-এর তথ্যানুসারে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা দেশের চলতি বছরের (২০১৮-১৯) জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। আর টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম।

এছাড়া চলতি বছরের জুন মাসে প্রকাশিত ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০১৮’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৫ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৪ হাজার ১৬০ কোটি টাকা।

এসব বিষয় বিবেচনা নিয়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে দুটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সটি ২২ সদস্য বিশিষ্ট। আর আঞ্চলিক টাস্কফোর্সটি ২০ সদস্য বিশিষ্ট।

কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সটি মানিলন্ডারিং এবং সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন সংস্থার গৃহীত কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে।  অর্থ, স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি পাচার এবং নারী, শিশু ও মানব পাচার, মাদকদ্রব্য চোরাচালানের রিপোর্টকৃত ঘটনাগুলোর বিষয়ে গৃহিত কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে।  পাশাপাশি মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাধাগুলো চিহ্নিত করবে ও তা দূরীকরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে।

কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক হলো বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আর সদস্য সচিব করা হয়েছে বিএফআইইউ-এর মহাব্যবস্থাপক ও অপারেশনাল হেডকে। যেখানে সদস্য হিসেবে রয়েছে এনবিআর সদস্য (কাস্টমস) ও  সদস্য (আয়কর), দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক (মানিলন্ডারিং), বিএফআইইউ এর উপপ্রধান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (সুপারভিশন সংশ্লিষ্ট), বাংলাদেশ সিউিরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক পর্যায়ের প্রতিনিধি, সমবায় অধিদপ্তরের পরিচালক, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক, এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক, রেজিস্টার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ এন্ড ফার্মসের নিবন্ধক, পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ক্রাইম), ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (কাউন্টার টেররিজম), বাংলাদেশ পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক, বিএফআইইউ মনোনীত তফসিলি ব্যাংক থেকে ৮ জন প্রতিনিধি, বিএফআইইউ মনোনীত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ২ জন প্রতিনিধি, বিএফআইইউ মনোনীত পুঁজিবাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ২ জন প্রতিনিধি, বিএফআইইউ মনোনীত এনজিও প্রতিষ্ঠান থেকে দুই জন প্রতিনিধি, বিএফআইইউ মনোনীত বীমা প্রতিষ্ঠান থেকে দুই জন প্রতিনিধি এবং বিএফআইইউ মনোনীত সমবায় প্রতিষ্ঠান থেকে দুই জন প্রতিনিধি।

কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সটি চারটি কার্যপরিধিতে আবদ্ধ। এগুলো হলো, বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, রিপোর্ট প্রদানকারী সংস্থার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষগুলো এবং বিএফআইইউ এর কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধন। রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ