রাইজিংবিডি স্পেশাল

সাড়ে ৩৭ লাখ টাকার পর্দার রহস্য উন্মোচনে দুদক

ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রোগীকে আড়াল করার আলোচিত সাড়ে ৩৭ লাখ টাকার পর্দাসহ ১৬৬ চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতির রহস্য উন্মোচনে মাঠে নেমেছে ‍দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ।

অভিযোগ অনুসন্ধানে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সরেজমিনে ফরিদপুর যাচ্ছে দুদকের বিশেষ টিম। উচ্চ আদালতের বিশেষ নির্দেশনা ও অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় অভিযোগটির অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি।

২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্পে মেসার্স অনিক ট্রেডার্স নামের একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাজার মূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক বেশি দাম দেখিয়ে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা উত্তোলনের অভিযোগ ওঠে। প্রক্রিয়াধীন ছিল আরো ১০ কোটি টাকার বিল উত্তোলনে।

এরই মধ্যে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করার পাশাপাশি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে দুদক টিম প্রধান উপ-পরিচালক শামছুল আলম। ‍দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র বিষয়টি রাইজিংবিডিকে জানিয়েছে।

গত ২২ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো তলবি নোটিশে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানের স্বার্থে ২০১২-১৩ হতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসাপাতালে সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি  স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী যাচাই ও মূল্য নির্ধারণ এবং বইপত্র সাময়িকী মূল্য যাচাই একান্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তিনজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি টিম গঠন পূর্বক টিমের সদস্যদের নাম, পদবি ও ফোন নম্বর অন্তর্ভুক্ত করে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

চিঠিতে বলা হয়, আগামী ২ ও ৩ অক্টোবর ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ ও ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে অনুসন্ধান টিমের সদস্য উপ-সহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান ও ফেরদৌস রহমান যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী যাচাই ও মূল্য নির্ধারণে সরেজমিনে পরিদর্শন করবে। যাচাইকালে সবরাহকারী ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির উপস্থিত থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। গঠিত বিশেষজ্ঞ টিমকেও সার্বিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে।

চিঠিতে দুদক টিম এ বিষয়ে ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ ও ফরিদপুর মেডিক্যাল কালেজ হাসাপাতালকে বিশেষজ্ঞ টিম গঠনের অনুরোধ জানানো হয়। যেখানে বিশেষজ্ঞ ওই টিমকে আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানা যায়, ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রোগীকে আড়াল করে রাখার এক সেট পর্দার দাম দেখানো হয় ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।  ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে মেসার্স অনিক ট্রেডার্স অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকার ১৬৬টি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে।  যেখানে প্রকৃত বাজার মূল্য ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৪৬৫ টাকা। এরই মধ্যে অনিক ট্রেডার্স ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার ৭৩৭ টাকার বিল উত্তোলন করে।  স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরো ১০ কোটি টাকার বিল বিভিন্ন অসঙ্গতিতে বিল আটকে দেওয়া হয়। বিল পেতে ২০১৭ সালের ১ জুন অনিক ট্রেডার্স হাইকোর্টে রিট করে। এরপরই মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কাছে ১০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতির তালিকা চেয়ে পাঠান। পরবর্তীতে বিষয়টি তদন্তে দুদককে নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট।

অভিযোগের বিস্তারিত তথ্যে দেখা যায়, পর্দা ছাড়াও ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা দামের একেকটি স্টেথিস্কোপের জন্য খরচ দেখানো হয় ১ লাখ সাড়ে ১২ হাজার টাকা, ১০ হাজার টাকার ডিজিটাল ব্লাডপ্রেশার মাপার মেশিন কেনা হয় ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। অব্যবহৃত আইসিইউর জন্য অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্টের দাম ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। খোদ জাপান থেকে আনলেও এর খরচ সর্বোচ্চ ৮০ লাখ টাকা হতে পারে বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা। অথচ প্ল্যান্টটি বন্ধ রুমটির দেয়ালে শ্যাওলা পড়ে নোনা ধরে স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

বিআইএস মনিটরিং প্ল্যান্ট স্থাপনে খরচ হয় ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। যেখানে বাজার দাম ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এভাবে প্রায় ১৮৬ গুণ পর্যন্ত বেশি দাম দিয়ে ১৬৬টি যন্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে মেসার্স অনিক ট্রেডার্স। যা জনবলের অভাবে অধিকাংশ যন্ত্রপাতি অকেজো পরে আছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১০ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও মালামাল সরবরাহ করে মেসার্স অনিক ট্রেডার্স। ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর ফমেক হাসপাতালের স্টোর অফিসার মো. আ. রাজ্জাক স্বাক্ষর করে ১০ প্রকারের যন্ত্রপাতি ও মালামাল বাবদ ১০ কোটি টাকার সরবরাহ করা মালামাল বুঝে নেন। কিন্তু গত কয়েক বছরের অযত্ন-অবহেলায় ধুলাবালি পড়ে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে।  গত ২০ আগস্ট  ৬ মাসের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য দুদককে নির্দেশনা দিয়েছিল আদালত। ঢাকা/এম এ রহমান/সাইফ