রাইজিংবিডি স্পেশাল

দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শেষে হলি আর্টিজানে অপারেশন

ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ভয়ংকর হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ১ জুলাই। জঙ্গিরা সেদিন যেন রক্তের হলি খেলায় মেতে উঠেছিল। তাদের হামলায় দুই পুলিশ সদস্য, ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ নিহত হন ২২ জন। রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় এরকম একটি হামলা হবে তা কেউ কল্পনাও করেনি।

সে দিনের সেই ভয়ংকর হামলার চিত্র ফুটে ওঠে পুলিশের দেয়া চার্জশিটে। ওই চার্জশিটের আলোকে ঘটনার বিশদ রাইজিংবিডি পাঠকদের জন্য তুলে ধরছেন নিজস্ব প্রতিবেদক মামুন খান। ধারাবাহিক বর্ণনার আজ সপ্তম পর্ব।

সুপরিকল্পিতভাবে সমাজের উচ্চ পর্যায়ের পরিবার থেকেই কর্মী বাছাই করতো নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতারা। মূলত: যে সব পরিবারের মা-বাবা ব্যবসা বা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন সন্তানদের তেমন সময় দিতে পারতেন না সেই সব হতাশাগ্রস্থ ছেলেদেরই তারা বাছাই করতো।

নানা কৌশলে ইসলামের অপব্যাখা দিয়ে সমাজ, সংসার, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে উৎসাহিত করে নিজেদের দলে ভেড়াতো। তারপর আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের ভয়ংকর সব কার্যকলাপে জড়িত হতে বাধ্য করতো। আর এভাবেই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে সুইসাইডাল স্কোয়াডে যুক্ত হতো।

জেএমবির একাংশ যারা নব্য জেএমবি নাম ধারণ করে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন ভাড়া বাসায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। হলি আর্টিজান বেকারি হামলায় অংশ গ্রহণকারী পাঁচজনসহ অন্যরা ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে মিরপুরের ১৫৯ মধ্য পাইকপাড়া (৪র্থ), পুরাতন বউবাজারের একটি বাসায় দ্বিতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণে রাকিবুল হাসান রিগেন, নুরুল ইসলাম মারজানসহ অন্যরা তাদের ট্রেনিং করায়।

প্রশিক্ষকেরা প্রশিক্ষণার্থীদের কোরআন হাদিসের রেফারেন্স উল্লেখ করে জিহাদ সম্পর্কিত অংশের অপব্যাখা দিত। সর্বোপরি রিগেন ‘রিয়াদুস সালেহিন’ নামক গ্রন্থ থেকে প্রশিক্ষণার্থীদের জিহাদ অংশ পড়ে শোনাতো এবং অপব্যাখা দিয়ে প্রশিক্ষণার্থীদের মানসিক প্রস্তুতি জোরদার করতো যাতে তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটে বলেন, তামিম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, সরোয়ার জাহান, শরিফুল ইসলাম খালেদ, মামুনুর রশিদ রিপন, জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নব্য জেএমবির উগ্রপন্থি কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণপ্রার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতো। তারা প্রশিক্ষণপ্রার্থীদের কোরআন-হাদিসের অপব্যাখা দিয়ে তাদের সুইসাইডাল স্কোয়াডে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত করতো। কোচিং সেন্টারের সার্বিক দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল তামিম চৌধুরী ও শরিফুল ইসলাম খালেদ।

তামিম চৌধুরীর পরিকল্পনায় ২০১৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে এদেরসহ শরিফুল ইসলাম ডনদের গাইবান্ধার সাঘাটি থানাধীন যমুনার চর/ফুলছড়ি চরে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করে। সামরিক প্রশিক্ষণে রায়হানুল কবির রায়হান, মেজর (অব.) জাহিদসহ অন্যরা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তারা অস্ত্র খোলা-জোড়া, পরিচালনা, আইইডি (ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) তৈরি ও ব্যবহার শেখাতেন। রায়হানুল কবির বোমা/গ্রেনেড নিক্ষেপ করার কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতো। এরপর তারা উত্তরবেঙ্গর বিভিন্ন স্থানে ও ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করে।

তামিম চৌধুরীর নির্দেশে র‌্যাশ হলি আর্টিজানে হামলাকারী রোহান ওরফে ইলবাবা এবং নিবরাস ওরফে লম্বুদের ২০১৬ সালের মে তে মিরপুর-১০ থেকে সদরঘাটে নিয়ে যায়। তারা ৫০০ টাকায় একটি নৌকা ভাড়া করে বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝখানে গিয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা শেখে। প্রথমে র‌্যাশ একটি গ্রেনেড নদীর মাঝখানে ফোটায়। তাতে বিকট শব্দ হলে মাঝি বলেন, কি করেন আপনারা? তখন রোহান ইমতিয়াজ মাঝিকে ছুরি দেখিয়ে চুপ থাকতে বলে। মাঝি ভয় পেয়ে আসামিদের কথা মত নৌকা চালায়। দ্বিতীয় গ্রেনেডটি রোহান এবং তৃতীয়টির বিস্ফোরণ ঘটায় নিবরাস।

গ্রেনেড চার্জের সময় একটি স্প্লিন্টারের আঘাতে রোহান পায়ে সামান্য আঘাত পায়। তখন র‌্যাশ ব্যাগ থেকে ব্যান্ডেজ বের করে রোহানের ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দেয়। তারপর তারা মাঝিকে দিয়ে নিরাপদ ঘাটে নৌকা ভেড়ায়। নৌকা থেকে নেমে তারা সদরঘাটের একটি ফার্মেসীতে গিয়ে রোহানের ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করে সিএনজি নিয়ে মিরপুর-১০ এ চলে যায়।

চার্জশিটে আরো বলা হয়, সমস্ত প্রশিক্ষণ শেষ করে হলি আর্টিজানে হামলার জন্য পাঁচ সদস্য বসুন্ধরায় একটি বাসায় অবস্থান করে প্রস্তুতি নিতে থাকে। তামিম চৌধুরীর নির্দেশে রিগেন ২০১৬ সালের জুন মাসে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার টেনাটেন্ট-৩ এর বাসায় ২/৩ বার গিয়ে হামলাকারীদের প্রশিক্ষণ দেয়। এছাড়া রিগেন ওই মাসের শেষ সপ্তাহে বসুন্ধরার বাসায় একদিন অবস্থান করে হামলাকারীদের সর্বশেষ প্রস্তুতি হিসেবে হামলার পূর্ব পর্যন্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করে।

রিগেন হামলাকারী পাঁচজনের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা যদি অপারেশন করতে গিয়ে মারাও যাও তবে তোমরা শহীদের মর্যাদা পাবে এবং নিশ্চিত বেহেস্ত নসিব হবে। হামলাকারীদের রিগেন নিশ্চয়তা প্রদান করে যে, তারা হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে। হামলার পর অ্যাপস এর মাধ্যমে মোবাইলে হামলার ছবি দেখে রিগেন বলে, আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভাল কাজ হয়েছে। তার প্রশিক্ষণ মত হামলাকারীরা কাজ করায় সে তাদের জন্য দোয়া করে।

 

ঢাকা/এনএ