রাইজিংবিডি স্পেশাল

‘আমারে নিয়ে যা বাবা’

শেষ বয়সে এসে মানুষ একান্ত আপন জনের শ্রদ্ধামিশ্রিত ভালোবাসায় সিক্ত হতে চায়। নাতি-পুতি নিয়ে হেসে খেলে পার করতে চায় জীবন সায়াহ্ন। কিন্তু সব থাকতেও যখন প্রিয়জনেরা বৈরি হয়ে ওঠে, তখন আর কিছুই করার থাকে না। যে সন্তানকে কলিজায় বেঁধে তিলে তিলে স্নেহসূধা দিয়ে বড় করে তুলেছে, সেই সন্তানই যখন রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে- তখন সেই হতভাগ‌্যকে যেনো মৃত‌্যুও পর করে দেয়।

৭৫ বছরের রাজ্জাক দেওয়ান। এ বয়সে অনেকেই বেশ সুস্থ-স্বাভাবিক থাকেন। তবে নানা রোগে জর্জরিত রাজ্জাককে বার্ধক‌্য যেনো পরম মমতায় জড়িয়ে নিয়েছে। শরীরের ডান পাশটা প্রায় অসাড়। ডান হাতটি অপুষ্টিতে বাঁকা হয়ে গেছে। কানে শোনেন না একেবারেই। দেহ কঙ্কালসার।

ভালোবাসার কাঙাল এই হতভাগ‌্য লোকটি মেয়েদের কাছে থাকতেন। কিন্তু মেয়েরা এখন আর বাবার প্রয়োজন বোধ করেন না। খেতে দেন না ঠিক মতো। গোসল করান না। সন্তানদের অযত্ন অবহেলায় কোনো রকমে বেঁচে থাকা অবুঝ এই বাবা এখন শিশুদের মতো হয়ে গেছেন। তাই দাওয়াত খাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বাইরে নিয়ে আসা হয় তাকে। এরপর রাস্তায় ফেলে রেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বাড়ি ফেরেন নিষ্ঠুর সন্তান। হয়তো ভাবেন, ‘এবার আপদ বিদেয় হলো’।

ধানমন্ডিতে মেয়ে রোজিনার বাসায় থাকতেন এই হতভাগ‌্য পিতা। দাওয়াত খাওয়ার কথা বলে কৌশলে বাবাকে ধানমন্ডির সাতরাস্তায় ফেলে যাওয়া হয়। সেসময় বিবেক বা স্মৃতি তাকে একটি বারের জন‌্যও নাড়া দিয়ে যায়নি। মনে হয়নি- হাঁটি হাঁটি পা পা করে যখন তিনি হাঁটতে শিখেছিলেন, তখন কার আঙ্গুল আঁকড়ে ধরে থাকতেন। পড়ে গিয়ে ব‌্যাথা পেলে কে তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতেন। পড়ে যাওয়া স্থানটিকে মিথ‌্যে করে মারধর করে কে তাকে সান্তনা যোগাতেন!

অসুস্থ শরীর নিয়ে দুদিন রাস্তায় পড়ে ছিলেন রাজ্জাক। এ দুদিন খেতে না পেয়ে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন। অথচ রাস্তায় পড়ে থাকা এই ব‌্যক্তির নাকি চন্দ্রা এলাকায় দুটি বাড়ি রয়েছে! এই প্রতিবেদককে কোমরে সুতা দিয়ে বেঁধে রাখা চাবির গোছাও দেখান তিনি। বলেন, ‘চন্দ্রায় আমার দুটো বাড়ি রয়েছে। ধানমন্ডিতে মেয়ের কাছে থাকি।’

শারীরিকভাবে অক্ষম এ বৃদ্ধকে রাস্তায় ফেলে যাওয়ার দুদিন পর এক ব‌্যক্তি সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে যান তার কাছে। কানে প্রায় শেনেনই না রাজ্জাক। তাই ওই ব‌্যক্তির কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। রাজ্জাকের অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে দয়া পরবশত তিনি কল‌্যাণপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ায় চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে ফোন করেন। তার ফোন পেয়ে কেয়ার সেন্টারের লোকজন রাজ্জাককে উদ্ধার করে নিয়ে যান।

রাজ্জাকের খবর নিতে এই প্রতিবেদক কেয়ার সেন্টারে গিয়ে দেখেন, একটি খাটে শুয়ে আছেন সেই হতভাগ‌্য পিতা। কঙ্কালসার দেহটি প্রায় মিশে আছে বিছানায়। প্রতিবেদককে দেখে তার মধ‌্যে শিশুসুলভ চাঞ্চল‌্য ভর করে। হারিয়ে যাওয়া শিশু যেমন বাবা-মায়ের কাছে যেতে চঞ্চল হয়ে ওঠে, তেমনি এই বৃদ্ধও ভেবেছেন তাকে নেয়ার জন‌্য বুঝি লোক পাঠানো হয়েছে। শোয়া থেকে চট করে উঠে বসেন বিছানায়। চাহনিতে রাজ‌্যের প্রত‌্যাশা। মেয়েদের কাছে ফিরে যেতে এই প্রতিবেদকের কাছে বারবার আকুতি জানাতে থাকেন তিনি।

এখানেই স্থান পেয়েছেন রাজ্জাক দেওয়ান

কানে শোনেন না বলে কথা বলতে এ প্রতিবেদককে চিৎকার করতে হচ্ছিল। সেসময় জড়ানো গলায় রাজ্জাক দেওয়ান বলেন, ‘আমি কানে শুনি না। আমার বাড়ি চন্দ্রা। সেখানে দুটি বাড়ি আছে। মেয়ের নাম রোজিনা। তারা ধানমন্ডির সাত মসজিদ এলাকায় থাকে। আমারে নিয়ে যা বাবা, আমি বাড়ি চিনব। আমি এখানে থাকব না।’

কথাগুলো বলার পর তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। প্রতিবেদকে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি যে অসুস্থ সেটি বোঝানোর জন‌্য কাপড় খুলে নিজের শারীরিক অক্ষমতাকে দেখানোর চেষ্টা করছিলেন। বৃদ্ধের এই আকুতি দেখে আশপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। কিন্তু সে আকুতি কি নিষ্ঠুর সন্তানের হৃদয় স্পর্শ করবে? তাই যদি হতো, তাহলে অপ্রয়োজনীয় জিনিসের মতো এমন রাস্তায় ফেলে যেতেন না বাবাকে। সে কথা কে বোঝাবে মেয়েদের কাছে ফেরার আশায় কান্নারত রাজ্জাক দেওয়ানকে?

কেয়ার সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ক মো. মিরাজ হোসেন বলেন, ‘আমরা যতটুকু বুঝতে পারছি, তিনি মেয়েদের কাছে থাকতেন। তবে মেয়েরা তার যত্ন নিতেন না। তাকে গোসল করানো কিংবা খেতেও দিতেন না ঠিক মতো। ঘটনার দিন তাকে দাওয়াত খাওয়ানোর কথা বলা হয়। এরপর বাসা থেকে বের করে ধানমন্ডির সাতমসজিদ এলাকার রাস্তায় ফেলে যান। এর বাইরে তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। ’

তিনি আরো বলেন, ‘গত ২০ নভেম্বর ধানমন্ডি থেকে এক ব্যক্তি ফোন করেন। পরে রাস্তা থেকে রাজ্জাক দেওয়ানকে উদ্ধার করা হয়। তিনি দুদিন রাস্তায় পড়ে ছিলেন। স্বজনদের খুঁজতে তার দেওয়া এসব তথ‌্য দিয়ে কেয়ার সেন্টারের ফেসবুকে পোস্ট দেয়া হয়েছে। তবে কানে শুনতে পেলে হয়তো তার কাছ থেকে আরো তথ‌্য জানা সম্ভব হতো।’

কেয়ার সেন্টারটিতে রাজ্জাক দেওয়ানের মতো ৬৩ জন অসহায় বৃদ্ধ রয়েছেন। তাদেরকে কেয়ার সেন্টারে রেখে খাওয়া-পরা ও চিকিৎসার ব‌্যবস্থা করা হয়েছে।

২০১৪ সালে চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার সেন্টারটি চালু করেন মিল্টন সমাদ্দার নামে এক হৃদয়বান ব‌্যক্তি। সেন্টারটিতে অবস্থানরত বাসিন্দাদের বেশির ভাগই নাম পরিচয়হীন রাস্তার মানুষ। আবার অনেকেই আছেন, যাদেরকে অপ্রয়োজনীয় ভেবে স্বজনেরা এখানে রেখে গেছেন।

ঢাকা/মাকসুদ/সনি