আনোয়ার হোসেন শাহীনমাগুরা, ৮ জানুয়ারি : প্রায় আশি বছর পুলিশের একান্ত সঙ্গী হয়ে থাকা থ্রি নট থ্রি রাইফেল এখন শোভা পাচ্ছে আনসার সদস্যদের হাতে।
পুলিশের আট দশকের সঙ্গী ও মুক্তিযুদ্ধসহ কালের স্বাক্ষী এসব রাইফেল এখন ব্যবহার করছেন খণ্ডকালীন দায়িত্বরত আনসার সদস্যেরা। পুলিশি অস্ত্রে বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় থ্রিনটথ্রি রাইফেল বাতিল হয়ে গেছে। তার জায়গা নিয়েছে স্বয়ংক্রিয় চাইনিজ রাইফেল। পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্য, “সময়ের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুলিশকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করে তোলা হচ্ছে। এখন অটোম্যাটিকের যুগ।”
থ্রিনটথ্রি রাইফেলটির কার্তুজ .৩০৩ ইঞ্চি (৭.৭ মিলিমিটার) বোরের। তাই চলতি কথায় থ্রি নট থ্রি জেমস লি নামক এক মার্কিন এই ‘বোল্ট অ্যাকশন’রাইফেলের নকশা বানিয়েছিলেন বলে পোশাকি নাম লি এনফিল্ড।
প্রতিবার গুলি ছোড়ার আগে বোল্ট করতে হয়। তাতে অনেকটা সময় লাগে। বোল্ট, অর্থাৎ ট্রিগারের উপরে ছিটকানির মতো অংশটি পিছন দিকে টেনে গুলি চালানো। ওজন ছয় কেজি। ফায়ারিংয়ের পর রাইফেলের উল্টো ধাক্কা বেশি। এনফিল্ডের রয়্যাল স্মল আর্মস ফ্যাক্টরিতেই রাইফেলটি প্রথম তৈরি হয়। সেটা ১৯০৭ সালে। তার পরে শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেখানেই বিশ্ব প্রথম দেখল থ্রিনটথ্রি’র পরাক্রম। এর পাল্লা (রেঞ্জ) এতটাই যে, এক কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যকেও ঘায়েল করতে পারে। তবে পাঁচশো মিটার দূরত্বের মধ্যে পর পর তিন জনকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারে থ্রি নট থ্রি’র একটা বুলেট!ব্রিটিশ আমলে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রথম পুলিশকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দেওয়া হয়। থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিছক একটি আগ্নেয়াস্ত্র নয়। এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইতিহাস ও পুলিশের সাফল্য-ব্যর্থতা ঘিরে নানা তর্ক-বিতর্ক।
বেশি ওজন ও স্বয়ংক্রিয় না হওয়ায় পুলিশ অবশ্য আগেই থ্রি নট থ্রি বাতিলের তোড়জোড় শুরু করে। এরপর পুলিশের হাতে আসে সেলফ লোডিং রাইফেলে (এসএলআর) তিরিশ কার্তুজের ম্যাগাজিন। একের পর এক গুলি ছুড়তে সক্ষম, বোল্টের বালাই নেই। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বহু পুলিশ সদস্যের অস্ত্র প্রশিক্ষণ ঠিকঠাক হয় না। আনাড়ি হাতে অটোম্যাটিক রাইফেল আসায় বেশি প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে হানাদার বধের মোক্ষম অস্ত্র ছিল আদ্যিকালের লি এনফিল্ড। বহ দূর থেকে নির্ভুল চাঁদমারিতে গুড়িয়ে দিয়েছিল শত্রুদের শিরদাঁড়া। এটা এত দিন পুলিশের অস্ত্রাগারেরও মেরুদণ্ড হয়ে ছিল। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের মাঝামাঝি পুলিশের কাছ থেকে অবসরে চলে যায় আট দশকের সঙ্গী থ্রি নট থ্রি রাইফেল। এর বদলে আসে স্বয়ংক্রিয় চাইনিজ রাইফেল ও শর্টগান। এখন এই রাইফেল নির্বাচনসহ বিশেষ প্রয়োজনে আনসারদের বহন করতে দেখো যায়।
মহম্মদপুর উপজেলার বাসিন্দা নূরুজ্জামান (৮০)। পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে পুলিশের কনেস্টেবল পদে চাকরি করেছেন। এখন তিনি অবসরে। তিনি বলেন, কালের নিয়মেই পুলিশের সংগ্রহশালায় ঠাঁই পেয়েছে থ্রি নট থ্রি। এক সময় রাজত্ব চলেছে ভুবনজয়ী লি এনফিল্ড ওরফে থ্রি নট থ্রি রাইফেলের। ১৯৭৮ সালে রাজাশাহীর বাগমারায় এক ঘটনায় জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ঘেরাও করে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে। তখন এই বন্দুকের গুলি ছোড়া হয়েছিল শূন্যে। পর পর চারটা। ফায়ারিংয়ের আওয়াজেই ক্ষিপ্ত জনতা ছত্রভঙ্গ। পুলিশ ঘেরাও মুক্ত।
তিনি অন্য একটা ঘটনার কথা বলেন, ‘দিনটা মনে আছে। ১৯৮০’র ৩ সেপ্টেম্বর, খাস জমি নিয়ে আন্দোলনে উত্তাল নেয়াখালীর চরাঞ্চল। প্রতিরোধ করতে গেলে জনতা আমাদের ঘিরে ফেলে। রেল লাইনের পাথর তুলে আমাদের দিকে ছুড়তে থাকে। এক কনস্টেবল পাথরের আঘাতে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। সেই সঙ্কটকালে পরিত্রাতা হয়ে দাঁড়ায় থ্রি নট থ্রি। আমি নিজে ছয় রাউন্ড ফায়ার করি। ক্ষিপ্ত মানুষকে ভয় পাওয়াতে থ্রি নট থ্রি’র আওয়াজই যথেষ্ট ছিল।’
মাগুরার পুলিশ সুপার জিহাদুল কবির জানান, কালের আবর্তনে পুলিশকে যুগোপযোগী করতে আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত করা হচ্ছে। এজন্যই থ্রি নট থ্রি এখন স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে।
রাইজিংবিডি / সনি