চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়ি থেকে ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করে ‘বর্জ্য শ্রমিকরা’। কিন্তু এসব শ্রমিকদের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। খোদ সিটি করপোরেশনই তাদের নিজেদের কর্মী হিসেবে স্বীকার করতে নারাজ। যদিও তারা এ প্রত্যক্ষভাবে নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর জন্য সিটি করপোরেশনের হয়েই কাজ করছে।
অনেকেই তাদের পাশদিয়ে যাওয়ার সময় নাক চেপে ধরে হাঁটেন। এতে তাদের ভ্রুক্ষেপ করতে দেখা যায় না। সব কষ্ট, ক্লান্তির পর দিন শেষে পরিবার-পরিজনের জন্য ঘরে খাবার নিয়ে যাবে এ আশায় সব পরিশ্রম। প্রতিদিনই একই গতিতে চলে তাদের জীবন।
কাঠামোগতভাবে এদের শ্রমজীবী বলা গেলেও অন্য সবার চেয়ে তারা আলাদা। তাদের কাজ করতে হয় দূষিত বায়ু আর উটকো গন্ধের মধ্যে। থাকে নানান ঝুঁকি। সিটি করপোরেশনের হয়ে কাজ করলেও তাদের নেই কোনো স্বীকৃতি কিংবা সুযোগ-সুবিধা।
প্রতিদিনই পাড়া-মহল্লার বাসাবাড়ি থেকে খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ, ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করে এই শ্রমিকরা। এতের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু-কিশোর। কোথাও কোথাও নারীদেরও এ কাজ করতে দেখা যায়। অনেকে আবার সংগ্রহ করা ময়লা থেকে কুড়িয়ে বের করেন প্লাস্টিক-কাগজ অথবা ধাতব বস্তু। সেগুলো বিক্রি করে দিনশেষে মেলে বাড়তি আয়।
মূলত এরা নিজেদের বর্জ্য শ্রমিক হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে এদের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি, কোনো নির্দিষ্ট আয়ের উৎসও। দিনের আয়ে দিন গেলেও কোথাও কোথাও মাসিক বেতনে চাকরি করে সংসার চলে। তবে এর মধ্যে রয়েছে মহাজনের দাদন। সেগুলোও পরিশোধ করতে হয় চড়া সুদে।
এরকম বেশ কয়েকজন শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় চার হাজারের বেশি ‘বর্জ্য শ্রমিক’ রয়েছে। মহানগরীর বিভিন্ন বাসা থেকে এরা বর্জ্য সংগ্রহ করে নিকটস্থ কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে চিরুণী তল্লাশিতে খুঁজে বের করা হয় বাড়তি আয়ের উপাদান। এরপর বর্জ্য দেওয়া হয় সিটি করপোরেশনের গাড়িতে।
কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ভিত্তিক সমিতির মাধ্যমে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। সাধারণত এসব সমিতির আওতায় কাজ করেন শ্রমিকরা। কোথাও মাসিক ৫ হাজার আবার কোথাও সাত হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে তারা।
বাসায় বাসায় ঘুরে বর্জ্য সংগ্রহ করে সেখান থেকে শ্রমিকরা যেসব প্লাস্টিক বা বিক্রয়যোগ্য বস্তু সংগ্রহ করেন সেগুলো বিক্রি করে বেতনের বাইরেও বাড়তি হয় তাদের। এছাড়া অনেকে বর্জ্য থেকে পাওয়া বিক্রয় উপযোগী মালামালের জন্যও কাজ করে বলে জানা গেছে।
সাধারণত বর্জ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজ দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন করে থাকে। তবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, দলিত সম্প্রদায়ের ছাড়াও অন্যান্যরাও এ কাজ করে থাকে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে রাজধানীতে শ্রমিকরা বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করছে। তবে এরা সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে পারে না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন যাত্রাবাড়ী এলাকায় ডিপোতে বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করেন মরিয়ম বেগম। এ পেশায় প্রায় ১৫ বছর ধরে আছেন তিনি। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী না হওয়ায় কোনো বেতন নেই তার। দিনে যা কাজ করেন, যা উপার্জন করতে পারেন তা দিয়ে রিকশাচালক স্বামীর সংসারে কিছুটা অর্থের যোগান দেন তিনি।
যাত্রাবাড়ী বর্জ্য সংগ্রহ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রিনা বেগম রাইজিংবিডিকে বলেন, আমরা সিটি করপোরেশনের কাজই করে দিচ্ছি। কিন্তু সেখান থেকে বেতন পাই না। বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করি। এলাকার সমিতি থেকে আমরা কিছু টাকা পাই। এই টাকায় সংসার চালানো খুব কষ্টের।
তিনি বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য বা সামাজিক কোনো নিরাপত্তা নেই। আর্থিক অনটনের মধ্যে ছেলে-মেয়েদের স্কুলেও পাঠাতে পারি না। ময়লার ভাগাড়ে কাজ করতে করতে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। কেউ খোঁজ নেয় না। কখনো কখনো হাত পা কেটে যায়। কিন্তু ভালো কোথাও চিকিৎসা করাতে পারি না।
এলাকা নিয়ন্ত্রণে সোসাইটি, কাজ করানো হয় শিশুদের
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, বাসা বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ, টাকা উত্তোলনের বিষয়টি সোসাইটি বা সমিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় শুধুমাত্র সোসাইটি এটি নিয়ন্ত্রণ করলেও অপরিকল্পিত এলাকায় গলি ভাগ করে প্রভাবশালীরা বর্জ্য সংগ্রহের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন।
দেখা গেছে, ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা মাসিক বেতনে শিশুরা বাসা থেকে ময়লা সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে গাড়িতে তোলে। কেন্দ্রে নেওয়ার পর নামানোর কাজও তারা করে।
ধানমন্ডির নিরিবিলি হাউজিংয়ের সামনে কথা হয় আলাউদ্দীন (১৩) নামে এক বর্জ্য শ্রমিকের সঙ্গে। সে জানালো, সারাদিন এসব ময়লা টেনে যা আয় হয় তা দিয়ে পরিবারে আর্থিক যোগান দেয়। তবে পরিশ্রমের তুলনায় তা একেবারেই কম বলে অভিযোগ এ কিশোর শ্রমিকরে।
শাহজাহান নামে ধানমন্ডি এলাকার একটি বাসার কেয়ারটেকার বলেন, এরা বেশি দিন কাজ করতে পারে না। কিছু দিন কাজ করে পালিয়ে যায়। এই কাজ করা তো সহজ না। বেশিরভাগই ছোট ছোট ছেলেরা ময়লা তুলতে আসে। বয়স ১৩ থেকে ১৮-এর মধ্যে। কাজ করার জন্য তারা ঢাকার বাইরে থেকে আসে।
এলাকার উপর নির্ভর করে বেতন
বাসা বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহকারীদের অনেকেই কাজ করে বেতন ছাড়া। এদের সঙ্গে চুক্তি থাকে ময়লা থেকে পাওয়া বিক্রয়যোগ্য মালামাল তারা সংগ্রহ করে বিক্রি করতে পারবে। আবার এদের অনেকে বেতনেও কাজ করে। এলাকার উপর ভিত্তি করে তাদের বেতনও নির্ধারিত হয়।
ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও উত্তরার পরিকল্পিত আবাসিক এলাকাগুলোতে বর্জ্য সংগ্রহকারীদের বেতন এলাকা ভেদে ভিন্ন হয়। সেখানে মাসিক ১২ থেকে ১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বর্জ্য সংগ্রহকারীরা বেতন পায় সেসব এলাকার বাসা থেকেও বড় অঙ্কের টাকা তোলে সোসাইটিগুলো।
অন্যদিকে, অপরিকল্পিত এলাকাসহ যেসব এলাকায় তুলনামূলকভাবে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষ বসবাস করেন সেসব এলাকায় সেখানকার বেতনের হার ভিন্ন। এসব এলাকায় পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত বর্জ্য সংগ্রহকারীদের বেতন দেওয়া হয়।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা ভাঙ্গাড়ি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সহজে ঋণ নিতে পারে। তবে শর্ত থাকে, সংগ্রহ করা প্লাস্টিক ও লোহা জাতীয় বস্তু ঋণদাতার কাছে নির্ধাতির মূল্যে বিক্রি করতে হবে।
রুস্তম আলী নামে এক শ্রমিক বলেন, বিপদে আপদে ঋণ নিতে পারি। কিন্তু কিছু বিক্রি করতে গেলে দাম পাই না। অন্য কোথাও বিক্রিও করতে পারি না। এজন্য খালি ঠকতে হয়। সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে না করতে আরেক বিপদ আসে। তখন আবারো ঋণ নিতে হয়।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি
বর্জ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা প্রাথমিক নিরাপত্তা সরঞ্জামও ব্যবহার করে না। তাই ময়লা আবর্জনা থেকে ইনফেকশনসহ নানা রোগব্যাধী হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আতিকুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, দেশের ওয়েস্ট ম্যানেজমন্টের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা সাধারণত ময়লা খোলা জায়গায় ফেলি। সেখানে থেকে বর্জ্য সংগ্রহকারীরা তা সংগ্রহ করেন এছাড়া বাসা থেকেও বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু আবর্জনায় কি আছে তা সংগ্রাহকরা জানে না।
তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোর মতো এখানে আবর্জনা অনুযায়ী আলাদা বিন রাখা হয় না। সব ময়লা একই বিনে ফেলা হয়। এতে সেখানে থেকে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বর্জ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরার সময় বি এবং সি ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে হাত এবং পা। এছাড়া শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যাসহ খাদ্যনালী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, কিডনি সংক্রমণ, যক্ষার মতো রোগ হতে পারে।
শ্রমিকদের সুরক্ষা দিতে বাসা বাড়িতে আলাদা ময়লার ঝুড়ি, আবর্জনা সংগ্রাহক এবং প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্তদের সার্বক্ষণিক মাস্ক ও বড় গ্লাবস ব্যবহারের নিশ্চয়তা তৈরির পরামর্শ দেন ডা. আতিকুর রহমান।
ঢাকা/নূর/এসএম