বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে সারা বিশ্বের পুঁজিবাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারেও।
যদিও বিগত কয়েক বছর ধরেই দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দেয়। বর্তমানে করোনা সংক্রমণের প্রভাবে তা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে সূচক, লেনদেন, বাজার মূলধন ও বিও হিসাবের পাশাপাশি বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ আশঙ্কাহারে কমেছে।
তবে করোনার প্রভাবে শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক পতন ঠেকাতে গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে কোম্পানিগুলোর শেয়ার ও ইউনিট দরের সার্কিট ব্রেকারের ফ্লোর প্রাইসের (যে দরের নিচে নামতে পারবে না) সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নেওয়া পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্লিষ্টরা। দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলেই পুঁজিবাজার আবারও চাঙা হবে—এমনটাই প্রত্যাশা বিনিয়োগকারীদের।
এদিকে দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক মন্দা অবস্থা বিরাজ করায় ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকেই এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ কমাতে শুরু করেছেন বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারী। এ সময়ের মধ্যে তিন-চার মাস ছাড়া অধিকাংশ সময়েই বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের পুঁজিবাজার করোনা আক্রান্ত। এ পরিস্থিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের গতিবিধি অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য বলে মনে করছেন অনেকেই।
পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করায় ২০১৯ সালে ব্যাংক খাতসহ অধিকাংশ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যাংক খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ স্থিতিশীল রেখেছিলেন বিদেশিরা। দীর্ঘ মন্দা পরিস্থিতি বিরাজের পর বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পরিবর্তে স্থিতিশীল হওয়া পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাবে সারা বিশ্বে মহামারি করোনাভাইরাসসে প্রকোপ দেখা দেওয়ায় ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকহারে কমেছে।
বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ব্যাংক খাতে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ৩০টি। আর চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক বাদে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা ২৯টি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংক খাতে বিদেশি বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকহারে কমেছে। ডিএসই ও সিএসইতে এ খাতে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২১টিতে, বিনিয়োগ স্থিতিশীল রয়েছে ৫টিতে এবং বিনিয়োগ নেই ৪টিতে। আর সিএসইতে বিদেশি বিনিয়োগ নেই ৩টি ব্যাংকে। সে হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে একটি ব্যাংকের শেয়ারেও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়েনি, বরং কমেছে।
এর আগে জানুয়ারি মাসে পুঁজিবাজারে ব্যাংক খাতে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগ স্থিতিশীল ছিল ১৩টিতে, বিনিয়োগ বেড়েছিল ৪টিতে, বিনিয়োগ কমেছিল ৮টিতে এবং বিনিয়োগ নেই ৩টি ব্যাংকে। জানুয়ারি মাসের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেনি ২টি ব্যাংক।
সে হিসেবে জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংক খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকহারে কমেছে। বিশেষ করে জানুয়ারিতে ৪টি ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে, ফেব্রুয়ারিতে একটিও নেই। আর জানুয়ারিতে ১০টি ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ স্থিতিশীল থাকলেও, ফেব্রুয়ারিতে তা ৫টিতে নেমে এসেছে। আর জানুয়ারিতে ৩টি ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল না। তবে ফেব্রুয়ারিতে তা আরো বেড়ে ৪টিতে দাঁড়িয়েছে।
দেশের পুঁজিবাজারে মৌলভিত্তি সম্পন্ন ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক খাতকে গণ্য করা হয়ে থাকে। সে হিসেবে এ খাতে বিনিয়োগ তুলনামূলক ঝুঁকি কম। কিন্তু ২০১০ সালে মহাধসের পর থেকেই এ খাতের কোম্পানিগুলো থেকে বিমুখ রয়েছেন সব বিনিয়োগকারী।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করায় দেশে পোর্টফোলিও বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না বিদেশিরা। তারা হয়তো বিনিয়োগের আরো ভালো জায়গা খুঁজচ্ছেন। বর্তমানে পরিস্থিতিতে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা দিশেহারা। ফলে বিনিয়োগ সরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।’
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুর রাজ্জাক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরেই আমাদের পুঁজিবাজারে মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়েছে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে করোনার প্রভাব বিরাজ করছে। সে হিসেবে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে আমাদের পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হলেই আবার বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে বলে আশা করছি।’
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসই’র ফেব্রুয়ারি মাসের হালনাগাদ তথ্য পর্যালোচনায় ব্যাংক খাতে বিদেশি বিনিয়োগের হালনাগাদ তথ্য নিম্নে তুলে ধরা হলো-
বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া ব্যাংকগুলোআল-আরাফা ইসলামী ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.২৫ শতাংশ। জানুয়ারি মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ২.৬১ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি তা কমে দাঁড়িয়েছে ২.৩৬ শতাংশে।
এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.৬৯ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৪৩.৯২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩.২৩ শতাংশে।
সিটি ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.০৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৯.৫৭ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ৯.৫৪ শতাংশে।
ইস্টার্ন ব্যাংকে (ইবিএল) বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.০৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ০.৪০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ০.৩২ শতাংশে।
এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংকে (এক্সিম) বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.১১ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৩.৫৯ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৪৮ শতাংশে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.১৬ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৪.২৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ৪.০৮ শতাংশে।
আইএফআইসি ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.০২ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১.০২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ১ শতাংশে।
ইসলামী ব্যাংকে ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.০৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ২৩.৫৭ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ২৩.৫৪ শতাংশে।
যমুনা ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.১৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১.৮২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছে ১.৬৯ শতাংশে।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.১০ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৫.৫৬ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫.৪৬ শতাংশে।
ন্যাশনাল ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.১৮ শতাংশ। জানুয়ারিতে মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১.৮৩ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৬৫ শতাংশে।
ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংকে (এনসিসি) বিনিয়োগ কমেছে ০.১১ শতাংশ। জানুয়ারিতে মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১.২২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.১১ শতাংশে।
ওয়ান ব্যাংকে বিনিয়োগ কমেছে ০.৫৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৩.২৪ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২.৭০ শতাংশে।
প্রিমিয়ার ব্যাংকে বিনিয়োগ কমেছে ০.৩৬ শতাংশ। জানুয়ারিতে মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৪.৬৩ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪.২৭ শতাংশে।
প্রাইম ব্যাংকে বিনিয়োগ কমেছে ০.০১ শতাংশ। জানুয়ারিতে মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৩.৫২ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৫১ শতাংশে।
পূবালী ব্যাংকে বিনিয়োগ কমেছে ০.০৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে মাসে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ০.৭৫ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ০.৭১ শতাংশে।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.০৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ০.৩০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ০.২৬ শতাংশে।
সাউথইস্ট ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.১২ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৫.২৭ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫.১৫ শতাংশে।
ট্রাস্ট ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.০৫ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১.১১ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.০৬ শতাংশে।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.১২ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১.৪০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.২৮ শতাংশ।
উত্তরা ব্যাংকে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ০.১৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ২.৯৫ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২.৮১ শতাংশ।
বিদেশি বিনিয়োগ স্থিতিশীল থাকা ব্যাংকগুলোচলতি বছরের জানুয়ারির মতোই ফেব্রুয়ারিতে বিনিয়োগ স্থিতিশীল রয়েছে এবি ব্যাংকে ১.০৩ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ায় ০.৩৭ শতাংশ, ডাচ-বাংলা ব্যাংকে ০.০২ শতাংশ, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে ১.৩৮ শতাংশ ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ১.২৬ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগ নেই ব্যাংকগুলোফেব্রুয়ারিতে বিদেশি বিনিয়োগ নেই ব্যাংকগুলো হলো- ঢাকা ব্যাংক, আইসিবি ইসলামীক ব্যাংক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংক। এনটি/সাইফ