রাইজিংবিডি স্পেশাল

‘টাকা পাঠাও, না হলে আমার লাশও পাবে না’

প্রিয়জনদের একটু ভালো রাখতে দূর প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিলেন ইছার উদ্দিন। আশা ছিল, দরিদ্র পরিবারের সবার স্বাদ-আহ্লাদ কিছুটা হলেও পূরণ করবেন। কিন্তু সে আশা পূরণ হলো না তার। তিনি জানেন যে, পরিবারের সামর্থ্য নেই। তারপরও শেষ সময়ে অপহরণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে দেশে পরিবারের কাছে ফোন করে ১০ লাখ টাকা পাঠাতে বলেন। দরিদ্র পরিবার পারেনি সে টাকা দিতে। ইছার উদ্দিন এখন কোথায় আছেন, বেঁচে আছেন না কি মারা গেছেন, জানা যাচ্ছে না। পরিবারের লোকজন আশায় বুক বেঁধে আছেন, ইছার উদ্দিন ফিরে আসবেন তাদের মাঝে। তা না হলে অন্তত লাশটা যেন শেষ বারের মতো দেখা যায়, সে আশায় আছেন স্ত্রী-সন্তান।

সম্প্রতি লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় মিজদাহ শহরে অপহরণকারীদের গুলিতে ২৬ বাংলাদেশি নিহত হয়। সেই নিহতদের তালিকায় ইছার উদ্দিনের নাম নেই। তবে ইছার উদ্দিন বেঁচে আছেন কি না তা জানেন না পরিবারের কেউ। ইছার উদ্দিনকে অপহরণের ঘটনায় তার স্ত্রীর ভাই ফার্নিচার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী ৭ জুন রাজধানীর তেজগাঁও থানায় ১০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন। আসামিরা হলেন—হযরত আলী, তার তিন ছেলে লিবিয়ায় প্রবাসী মো. সজীব, সুজন মিয়া, সঞ্জিত, মৃত রফিক মিয়ার তিন ছেলে জাফর, শাকিল, সুজন; কাওসার, মামুন ও দুবাইয়ে অবস্থানকারী আফ্রীন আহমেদ।

আসামিদের বিরুদ্ধে ইছার উদ্দিনসহ তিনজনকে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তিনজনের মধ্যে সজলের পরিবার পাচারকারীদের টাকা দিয়েছে। তারপরও তাকে মারধর করে গুরুতর আহত করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি লিবিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সজলের খোঁজ পাওয়া গেলেও ইছার উদ্দিন এবং বিজয়ের সন্ধান পাচ্ছে না তাদের পরিবার।

মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ইছার উদ্দিনকে লিবিয়ায় পাঠাতে ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা চায় আসামিরা। আমরা সরল বিশ্বাসে তাদের টাকা দিয়েছি। কিন্তু এরপরও আসামিরা আরো ১০ লাখ টাকা আমার বোনের কাছে দাবি করে। তারা বলে, আরো ১০ লাখ টাকা এক দিনের মধ্যে পাঠাবি। তা না হলে তোর স্বামীকে মেরে ফেলব। ইছার উদ্দিন আমার বোনকে বলেছে, টাকা পাঠাও, না হলে আমার লাশও পাবে না। তারা আমার ভগ্নিপতিকে অমানবিক নির্যাতন করেছে। তার কান্নাকাটি রেকর্ড করে বোনের মোবাইলে পাঠিয়েছে। এটা শোনার পর থেকে আমার বোন পাগলপ্রায়। খাওয়া-দাওয়া নাই। অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বোনটি আমাদের বড়ই আদরের। বিয়ে দিয়ে তাকে বাড়িতেই রেখে দিয়েছি। আর তার কপালে কি না এ রকম দুঃখ। তা দেখে সহ্য হয় না।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার ভাগ্নিটা তার বাবার জন্য চিৎকার করে কান্নাকাটি করে। বলে, বাবাকে এনে দাও। আমি বাবার কাছে যাব। তখন তাকে কী বলে যে শান্ত্বনা দেব, বুঝতে পারছি না।’

মোহাম্মদ আলী জানান, দালালদের পক্ষ থেকে আশা দেওয়া হচ্ছে, তাকে আজ-কালের মধ্যে ফিরিয়ে দেবে। এমনকি টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাসও দিচ্ছে। টাকা দিয়ে কী করব? দরকার হলে বাড়ি-ঘর বিক্রি করে আরো টাকা দেব। আমার ভগ্নিপতি বেঁচে থাকলে তাকে জীবিত, আর যদি মরে যায় তাহলে তার লাশটা অন্তত যেন তারা ফিরিয়ে দেয়। আমার বোন আর তার মেয়ের দিকে তাকানো যায় না। আমরা দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই।’

একই এলাকার বিজয় নামের একজনও পাচারের শিকার হয়েছেন। তার কোনো খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার। বিজয়ের ভাই ডালিম মিয়া বলেন, ‘৪ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে তাকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছি। কিছু জমানো টাকা আর আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ করে দালালদের টাকা দিয়েছি। এখন ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। বাবা-মা তার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আমরা তার সন্ধান চাই। দালালদের উপযুক্ত বিচার চাই।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্লবী জোনাল টিমের পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) লিয়াকত আলী জানান, এ মামলায় এখন পর্যন্ত তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তবে অনেকেই দেশের বাইরে আছেন। তারা দেশে এলে বা অন্য কোনো মাধ্যমে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হবে।

ভিকটিম জীবিত না মৃত, এ বিষয়ে জানতে চাইলে এ তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘ভিকটিমের পরিবার বা আমরা এখনো জানতে পারিনি, তিনি জীবিত না মৃত।’

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ইছার উদ্দিনকে লিবিয়ায় পাঠাতে প্রথমে ৬০ হাজার টাকা এবং সেখানে পৌঁছানোর পর ৪ লাখ টাকা আসামিদের (দালাল) দিতে হয়। গত বছর ৩ ডিসেম্বর আসামি কাওসার, সুজন এবং শাকিল ইছার উদ্দিনকে ঢাকায় নিয়ে আসে। সেখান থেকে মামুন তাকে চট্টগ্রামে নিয়ে যায়। পরে তাকে দুবাই থেকে লিবিয়া নিয়ে যাওয়া হয়। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর হযরত আলীকে ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। ২৫-২৬ দিন আগে ইছার উদ্দিনের স্ত্রী সুমাইয়া জানতে পারেন, তার স্বামীকে বেনগাজীতে বন্দিশালায় রেখে টাকার জন্য মারধর, নির্যাতন করা হচ্ছে। নির্যাতনে জাফর, সজীবসহ অজ্ঞাত অনেকে অংশ নেয়। ইছার উদ্দিনকে টর্চার সেলে মারধরের পর কান্নাকাটির শব্দ আসামিরা তার পরিবারকে শোনায় এবং সুমাইয়ার মোবাইলে নির্যাতনের অডিও ম্যাসেজ পাঠায়। আরো ১০ লাখ টাকা পাঠাতে বলে আসামিরা। টাকা না পাঠালে ইছার উদ্দিনকে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয় তারা। সাধ্য না থাকায় পরিবারটি টাকা দিতে পারেনি। পরে আসামি জাফর, সজীব ও তার সহযোগীরা ইছার উদ্দিনকে মারধর করতে থাকে। তখন ইছার উদ্দিন বাঁচার জন্য আকুতি জানাতে থাকে।

জাফর, সজীব ও তার সহযোগীরা মোবাইলে ম্যাসেজ দেয়, ‘সব টাকা দিবি। এই টাকা আমরা একা খাই না। লিবিয়া, সিরিয়ার মিলিশিয়াদেরও ভাগ দিতে হয়। তাদের সহায়তা ও আশ্রয়ে আমরা এসব কাজ করি।’

বাদী অভিযোগ করেন, আসামিরা সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারী দলের সক্রিয় সদস্য। তারা ইছার উদ্দিনকে লিবিয়া থেকে পাচার করে হত্যা করে গুম করে ফেলেছে। আসামিরা নিরীহ সাধারণ মানুষকে বিদেশে পাঠানোর নামে অপহরণ করে টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে মানব পাচারকারীরা নির্যাতনের ভিডিও ধারণ ও কান্নার শব্দ মোবাইলে রেকর্ড করে পাচার হওয়া লোকদের পরিবারের কাছে পাঠায়।

এ মামলায় এখন পর্যন্ত সুজন মিয়া, হযরত আলী ও নাজমুল হাসান নামের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সুজন মিয়া দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অপর দুই আসামিও কারাগারে আছে। ঢাকা/মামুন খান/রফিক