রাইজিংবিডি স্পেশাল

‘দুঃসময়ে সাহসী বাজেট’

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করেছেন।  প্রস্তাবিত বাজেটকে সাহসী বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেকরা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, রাজস্ব আহরণের গতি প্রকৃতি বিগত অর্থবছরের শুরু থেকেই ভালো ছিল না।  করোনা আসার পর বেশি খারাপ হয়েছে।  এছাড়া প্রতি বছর কোনও ধরনের সংস্কার ছাড়াই এনবিআরের জন্য বড় লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। 

তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে যা বলা হয়েছে তাতে এক বছরে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের বেশি জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা বাস্তবসম্মত নয়। জিডিপির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা অর্জন সম্ভব নয়। এসব লক্ষ্যমাত্রা কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

তিনি বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে—তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। প্রথমত, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়েছে, এটা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্জন করা সম্ভব নয়।  বিশ্ব ব্যাংক ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রাক্কলন করেছে ১ শতাংশ, এটি হয়তো আরো বেশি হবে।  সেখানে ৪-৫ শতাংশ প্রাক্কলন করা হলে হয়তো উচ্চাভিলাষী হতো না।

প্রস্তাবিত বাজেটকে অসাধারণ সময়ে একটি সাধারণ বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. দেবপ্রিয় ভট্রাচার্য। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, করোনার কারণে আমরা একটি অসাধারণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।  এই সময়ে বাজেটে নতুন কিছু প্রত্যাশা ছিল।  কিন্তু সরকার একটি সাধারণ বাজেট দিয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে কৌশলগত ৪টি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।  এগুলো হচ্ছে- সরকারি ব্যয় বাড়ানো, বিশেষ ঋণ সুবিধা দেওয়া, নিরাপত্তাবলয় সম্প্রসারণ এবং বাজারে তারল্য সঞ্চালন।  এই ৪টি লক্ষ্য খুবই সঠিক।  কিন্তু যে বাজেট কাঠামোর ওপর এটিকে দাঁড় করানো হয়েছে, সেটি একেবারেই বাস্তবতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।  এছাড়া বাজেট তৈরিতে যে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি ছিল, সেটি অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন। 

তিনি বলেন, বাজেটের সব প্রাক্কলন সাধারণত সংশোধিত বাজেটের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে করা হয়। ফলে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অতিরঞ্জিত। উদাহরণস্বরূপ, রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাস্তব নয়।

দেবপ্রিয় ভট্রাচার্য বলেন, করোনা সংক্রান্ত যে পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তা আগের কোনও প্রকল্পের সম্প্রসারণ অথবা প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের অংশ।  নতুনভাবে কোনো কর্মসূচি এখানে দেখছি না। এর মানে, করোনার ক্ষেত্রে আগের ঘোষণাগুলো লকইন করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ও অর্থনীতিবিদ ড. শামসুল আলম বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার এটি প্রথম বাজেট। একটি দুঃসময়ের মধ্যে একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে হয়েছে সরকারকে। এটি একটি সাহসী বাজেট হয়েছে।  একদিকে চলমান করোনা মহামারি অন্যদিকে দেশের আর্থিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি স্থবির।  এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে প্রস্তাবিত বাজেট প্রণয়ন অনেকটাই দুঃসাহসিক কাজ হয়েছে।

তিনি বলেন, এবারের বাজেট প্রণয়ন সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।  দেশের শিল্প ও বাণিজ্য খাতের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে রাজস্ব খাতে অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে।  এরপরও বাজেটের আকার কমেনি। প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের জীবন বাঁচানোর ওপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।  এজন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে।  এর সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে।  সামগ্রিকভাবে এবারের বাজেট অনেক সীমাবদ্ধতা এবং  দুঃসময়ে একটি ভালো বাজেট হয়েছে বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (বিআইডিএস) এর গবেষণা পরিচালক ও  অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত বলেন, এবারের বাজেট প্রণয়নে সত্যিকার অর্থেই অনেক সমস্যা অতিক্রম করতে হয়েছে।  করোনাভাইরাসের কারণে আমরা একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছি।  এ সময় এতবড় একটি কর্মযজ্ঞ উপস্থাপন করা সহজ ছিল না।  বাজেটে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।  এই সীমাবদ্ধাতা অতিক্রম কোন সুযোগ ছিল না।  সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই বাজেট দিতে হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে স্বাস্থ্যজনিত। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।  এ থেকে বিশ্ববাসী কবে নাগাদ মুক্ত হতে পারবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।  তাই এবারের বাজেট প্রণয়নে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এসেছে।  এ বিষয়ে বাজেটে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।  এখন এটা নির্ভর করবে সঠিক বাস্তবায়নের ওপর।  করোনা মহামারি থেকে আমরা যত তাড়াতাড়ি বের হতে পারবো আমাদের জন্য তত মঙ্গল হবে।

তিনি বলেন, বাজেট প্রণয়নে অনেক তথ্যের ঘাটতি রয়েছে।  বিদ্যমান অবস্থায় এটা স্বাভাবিক। এরপরও সবগুলো খাতকে গুরুত্ব সহকারে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।  বাজেটের আকার না কমে বরং বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা হয়েছে।  রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।  বিদ্যমান অবস্থায় রাজস্ব আদায়ে কতটা সফলতা অর্জন করা যাবে সেটা দেখার বিষয় রয়েছে।  কারণ যেসব খাত থেকে রাজস্ব আসবে সেসব খাতগুলোর অবস্থা সুবিধার নয়।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিচার্স অ্যান্ড পলিসি ইন্ট্রিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‌্যাপিড) এর নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. মু. আবু ইউসুফ বলেন, কভিড-১৯ পুরো বিশ্বের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।  সমসাময়িক এতবড় বিশ্ব বিপর্যয় দেখা যায়নি। এ অবস্থায় একটি নতুন বাজেট প্রণয়ন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।  আমার কাছে মনে হয়েছে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মানুষকে বাঁচানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।  বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তার বলয় বাড়নো, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সম্প্রসারণের উদ্যোগ, কৃষি ও শিক্ষা খাতকে অনেকটাই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।  তবে স্বাস্থ্য খাতে আমরা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সুস্পষ্ট ঘোষণা আশা করেছিলাম।

তিনি বলেন, গ্রামীণ পর্যায়ে ১৩৮০০ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র রয়েছে।  আরো ২৫০টি নতুন কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে গ্রামীণ  জনপদের মানুষদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হবে তাদের চিকিৎসার জন্য শহরে দৌড়াতে হবে না।  পর্যায়ক্রমে এসব স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।  আশার বিষয় হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু এ বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে তদারকি করছেন কাজেই এ নিয়ে নির্ভাবনায় থাকা যায়। হাসনাত/সাইফ