রাইজিংবিডি স্পেশাল

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি রোধে দুদকের সুপারিশ বাস্তবায়ন কতদূর?

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর এক বছর পেরিয়ে গেছে। সে প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই ঘুরে-ফিরে একই ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মে জর্জরিত স্বাস্থ্য খাত।  করোনার মতো মহাদুর্যোগের মধ্যেও মাস্ক, পিপিই কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অনুসন্ধান ও তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও দুর্নীতির প্রকৃত উৎস বন্ধে পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি।’

২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি দুদক স্বাস্থ্য খাতে যন্ত্রপাতি ক্রয়, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি কিংবা ওষুধ সরবরাহের ১১ পর্যায়ে দুর্নীতি চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে ২৫টির মতো সুপারিশ জমা দিয়েছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের হাতে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক দলের তৈরি করা প্রতিবেদন তুলে দিয়েছিলেন সংস্থাটির কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান। 

দুদকের সুপারিশ কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, তা জানতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মাইদুল ইসলাম প্রধান দাবি করেছেন, মন্ত্রী দুদকের সুপারিশগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নিয়েছেন।

দুদকের সুপারিশ কতটুকু বাস্তবায়ন দেখছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দুদকের সুপারিশ হয়ত আমলে নিয়েছে।  আমাদের সুপারিশ দেওয়ার পর কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জেনেছি। এ বিষয়ে আমাদের একটি টিম কাজ করছে।  তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।  আমরা মনে করি আমাদের সুপারিশ আমলে নিয়ে পদক্ষেপ নিলে অবশ্যই এ সেক্টরে দুর্নীতি হ্রাস পাবে।  দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে।’

অন্যদিকে, দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এ বিষয়ে বলেন, ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে কমিশন কর্তৃক গঠিত প্রাতিষ্ঠানিক টিম কাজ করেছে। গত বছর কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক টিমের একটি প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হলে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম প্রতিরোধ করা সহজ হবে।’

দুদকের প্রতিবেদনে দুর্নীতির ১১ উৎস চিহ্নিত করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে—সরকারি হাসপাতালে নিয়োগ–বদলি, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণার্থী বাছাইয়ে কোনো নীতিমালা মানা হয় না। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কর্মচারীরা একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকার সুবাদে স্থানীয় দালালদের সমন্বয়ে সংঘবদ্ধ চক্রে পরিণত হয়। যারা রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগে অতিরিক্ত অর্থ নেয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম চালানোর জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ না দিয়েই যন্ত্রপাতি সরবরাহ হয়, ফলে দীর্ঘকাল অব্যবহৃত থেকে তা নষ্ট হয়।  একই সঙ্গে কোথাও কোথাও যন্ত্রপাতি মেরামতের নামে  অর্থ আত্মসাৎ হয়।  অন্যদিকে, হাসপাতালে একটি সংঘবদ্ধ দালাল চক্র দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় গরিব রোগীদের উন্নত চিকিৎসার প্রলোভন দেখিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যায়।

বিনিময়ে ওই সব হাসপাতালে চলে কমিশন বাণিজ্য।  হাসপাতালের ওষুধ রোগীদের না দিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করা হয়।  কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনৈতিক প্রভাবে নিম্নমানের বা অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনা হয়।  এক্ষেত্রে অনিয়ম–দুর্নীতির মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়।  একটি চক্রের আঁতাতে নিম্ন মানের ও নকল ওষুধ বিভিন্ন কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ও চিকিৎসকদের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করা। প্রভাবশালী চক্র হাসপাতালের চিকিৎসক- কর্মচারীদের প্রভাবিত করে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগীদের অর্থ হাতিয়ে নেয়। এমনকি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন করে মেধা যাচাই না করে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করারও প্রমাণ রয়েছে।

অন্যদিকে, স্বাস্থ্য খাতের ওই দুর্নীতি প্রতিরোধে সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল- প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের উন্মুক্ত স্থানে সিটিজেন চার্টার  ও হাসপাতালে কী কী ওষুধ স্টকে আছে তা প্রদর্শন করা।  ওষুধ ও মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় দুর্নীতি বন্ধে ক্রয় কমিটিতে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা ও ইজিপিতে টেন্ডার আহ্বান করা। দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার বিধান করা। সরকার নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মূল্য তালিকা জনসমক্ষে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা ও ই-রেজিস্টার চালু করা।  জেলা–উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুমোদনহীন ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে  শক্তিশালী নজরদারি কমিটি গঠন করা। নকল ওষুধ ও কারখানার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করা।

কোনো চিকিৎসক একই কর্মস্থলে ৩ বছর চাকরি করার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার বদলি কার্যকর হবে, এমন নীতিমালা করা। প্রত্যন্ত এলাকায় পদায়নকৃত চিকিৎসকদের প্রণোদনার বিধান করে কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক উপস্থিতি নিশ্চিত করা। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের নাম না লিখে জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করা ও সব নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু করা ইত্যাদি।

 

ঢাকা/এম এ রহমান/রফিক