রাইজিংবিডি স্পেশাল

১০ বছরেও হদিস নেই ১৫৬ কোটি টাকার

২০১১-২০১২ অর্থবছরে এলসির বিপরীতে ছাড় হয়েছিল ১৫৬ কোটি টাকা। প্রায় ১০ বছর পর এখন তা সুদ-আসলে ৫০০ কোটি টাকা হয়েছে।

অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা থেকে এলসির বিপরীতে ছাড় করা ওই টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছে না বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিষ্ঠান দুটির অনুসন্ধানে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

মেসার্স বিটিএল, মেসার্স মাহিন টেক্সটাইল ও মেসার্স পিনাকল টেক্সটাইল নামের অস্ত্বিত্বহীন তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া হয়েছিল ওই টাকা। নথিপত্রে মো. মাহতাব হোসেনকে প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক দেখানো হয়েছে। ঋণের বিপরীতে ছিল না কোনো মর্টগেজ। শুধু সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখার (বর্তমানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) মাদার এলসির বিপরীতে টাকাগুলো ছাড় দেখানো হয়েছিল। ওই ঋণ কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যেতে পারেন অগ্রণী ব্যাংকের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অনুসন্ধানে এ ঋণের সঙ্গে হলমার্ক কেলেঙ্কারির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

দুদকের উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান বর্তমানে অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছেন। তদারককারী কর্মকর্তা হলেন পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। অনুসন্ধান চলমান থাকায় তারা এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেছেন, ‘অগ্রণী ব্যাংকের ইস্যুকৃত আদেশে বৈদেশিক বিনিময় বাণিজ্য ঋণের অর্পিত ক্ষমতা অনুযায়ী, একজন মহাব্যবস্থাপক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে রপ্তানি ঋণপত্রের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকের অর্থায়ন না থাকলে সবোর্চ্চ ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত স্থানীয় বিল ক্রয়ের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রিন্সিপাল শাখা উক্ত সীমা লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে জাল কাগজপত্রের ভিত্তিতে ভুয়া স্থানীয় এলসির মাধ্যমে ঋণ দেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘অগ্রণী ব‌্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার নথিতে প্রতিষ্ঠান তিনটির ঠিকানা নেই। প্রকৃতপক্ষে, ওই তিনটি প্রতিষ্ঠান পণ্য কেনাবেচা বা সরবরাহ ছাড়াই ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে এবং সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন শেরাটন শাখা ও প্রিন্সিপাল শাখার কর্মকর্তাদের যোগসাজসে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।’

এ বিষয়ে দুদকের পরিচালক (জনংযোগ) প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘অনেক আগের ঘটনা। বিস্তারিত না জেনে এ মুহূর্তে মন্তব্য করা যাবে না।’

দুদক সূত্রে জানা যায়, অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় ২০১৬ সালে পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে ১৫৬ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির তথ্য পাওয়া যায়। জনৈক মাহতাবের তিন প্রতিষ্ঠান মেসার্স বিটিএল, মেসার্স মাহিন টেক্সটাইল ও মেসার্স পিনাকল টেক্সটাইল সুতা বিক্রি করেছে হলমার্ক গ্রুপ, প্যারাগন, নকশি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছে। কিন্তু এসব বিল ও কেনাবেচার কাগজপত্র ছিল সম্পূর্ণ ভুয়া। এখানে পণ্য উৎপাদন, লেনদেন ও সরবরাহ হয়নি। অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভুয়া বিল বিক্রি করা হয়েছে। অথচ পণ্য না পেলেও পাওনাদারদের টাকা ঠিকই পরিশোধ করতে হয়েছে সোনালী ব্যাংককে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন সূত্রে আরো দেখা যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে শাখা কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠান তিনটির ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৫৬ কোটি টাকা দেয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় বিল কিনে শাখার ঋণ পোর্টফোলিওকে ঝুঁকিপূর্ণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তিন প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী সরেজমিন পরিদর্শনে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিদল। কিন্তু দলটি দুটি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি।

ওই কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত অগ্রণী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান খান, উপ-ব্যবস্থাপক জহরলাল রায়, সহকারী মহাব্যবস্থপক মো. আবদুল আজিজ দেওয়ান ও এসপিও হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছিল।

সূত্র আরো জানায়, ঋণ কেলেঙ্কারি মধ্যে হলমার্ক গ্রুপ, প্যারাগন, নকশি ও অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পণ্য সরবরাহের বিপরীতে সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখার এলসি ও স্বীকৃতিতে শাখা নির্ধারিত তিনটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে মোট ১০৮ কোটি টাকা মূল্যের ১০৫টি স্থানীয় বিল কেনা হয়। যার মধ্যে ৪২ কোটি টাকা মূল্যের ৪৫টি বিল ইতোমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে।

২০১৬ সালের ২২ জুন অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এর আগে দুদকের সাবেক উপ-পরিচালক সৈয়দ আহমেদ ও মো. বেনজীর আহম্মদ অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্বে ছিলেন। আদালতে রিট সংক্রান্ত জটিলতায় দীর্ঘদিন অনুসন্ধান আটকে থাকার পর পুনরায় অনুসন্ধান শুরু হয়।

   

ঢাকা/এম এ রহমান/রফিক