রাইজিংবিডি স্পেশাল

রাইড শেয়ারকারীদের কষ্টের জীবন

শুক্রবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ১১টা। রাজধানীর কমলাপুর রেল স্টেশনের সামনের রাস্তা। মোটরসাইকেলের ওপর হাত-পা গুটিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন মো. আদিল (৪৫)। ডাক দেওয়ামাত্রই উঠলেন তিনি। বললেন, ‘কই যাবেন? শরীরটা ক্লান্ত, এজন্য ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম।’

আলাপচারিতায় আদিল জানালেন, ভোরে লালবাগের বাসা থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছেন। শুক্রবার হওয়ায় ভাড়া তেমন মেলেনি। গভীর রাত পর্যন্ত মোটরসাইকেল চালানোর পরিকল্পনা তার। সুযোগ পেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।

আদিল বলেন, ‘করোনা মহামারির আগে ১০ বছর ধরে পুরনো গাড়ি বেচাকেনা করতাম। ভালোই চলচিল। করোনার কারণে ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ঢাকায় থাকা-খাওয়া, ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা, সর্বোপরি সংসার নিয়ে প্রতিটা মুহূর্তে চিন্তায় আছি। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। এ কারণেই এ পেশাকে বেছে নিতে হলো।’

একই দিন দুপুরে মতিঝিলে কথা হয় রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান ‘পাঠাও’ এর মোটরসাইকেলচালক মাহবুব আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দুই বছর আগে কামরাঙ্গীর চর এলাকায় এলপি গ্যাসের ব্যবসা করতাম। বিভিন্ন বাসা, হোটেল ও দোকানে বাকিতে গ্যাস সরবরাহ করতাম। কিন্তু করোনার কারণে অনেক লোকই ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। বাকি টাকা তুলতে না পেরে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সংসার তো চালাতে হবে। এক মেয়ে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে সংসার চলছিল না। অভাবে থাকলেও লোকলজ্জার ভয়ে অন‌্য কাজ করতে পারিনি। কিছুদিন বেকার ছিলাম। পরে বেছে নিলাম পাঠাও-উবারে মোটরসাইকেল চালানোর পেশা। সারা দিনে ৫০০-৭০০ টাকা আয় হয়। তা দিয়ে কোনোরকমে জীবন চলছে।’

ফার্মগেটে কথা হয় পারভেজ খানের সঙ্গে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তিনি। করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি হারিয়েছেন। এখন পাঠাওয়ের অধীনে মোটরসাইকেল চালান।

পারভেজ খান বলেন, ‘বেসরকারি কোম্পানিতে মার্চেন্ডাইজিংয়ে কাজ করতাম। চাকরি চলে যাওয়ায় আমাকে পথে আসতে হয়েছে। ছয় সদস‌্যের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। পরে পাঠাও-উবারে মোটরসাইকেল চালানোর সিদ্ধান্ত নিই। সারা দিন মোটরসাইকেল চালাই। কখনো কখনো গভীর রাত পর্যন্ত যাত্রী টানতে হয়। অনেক সময় শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। রাস্তায় বাইকের ওপর শুয়ে থাকি। পরিবার চালানোর খরচ তো লাগে। এ খরচ যতক্ষণ পর্যন্ত না ওঠে, ততক্ষণ বাসায় যেতে পারি না। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, এমনকি প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও আমাকে এভাবে রাস্তায় থাকতে হয়। জানি না, কবে এটা থেকে মুক্তি মিলবে।’

পাঠাও-উবারের একাধিক মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার কারণে রাজধানীতে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী বেকার হয়েছেন। জীবিকার তাগিদে তারা রাইড শেয়ারিং পেশা বেছে নিয়েছেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যাত্রী পরিবহন করেন তারা। কোনোদিন ৫০০-৭০০ টাকা, কোনোদিন ১ হাজার টাকাও উপার্জন হয়। তা দিয়েই জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা।

রাতে মোটরসাইকেল চালান কেন? এ প্রশ্নের জবাবে একজন বলেন, ‘আমরা অনেকেই আগে ভালো চাকরি করতাম। চাকরি হারিয়ে এ পেশায় এসেছি। লোকলজ্জায় দিনে ভাড়া খাটতে পারি না। আবার অনেকের গাড়ির কাগজপত্র ঠিক নেই। দিনে ট্রাফিক পুলিশ ঝামেলা করে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই অনেকে রাতের বেলা মোটরসাইকেল চালান।’

এক শ্রেণির চালক আছেন যারা ইচ্ছাকৃতভাবে রাতে মোটরসাইকেল চালান। তাদের অনেকেই মাদকাসক্ত, যারা রাতে চলাচল করতে বেশি পছন্দ করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে শুরুতে শুধু অ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ের প্রচলন হলেও এখন অনেকেই স্বাধীনভাবে রাইড শেয়ারিং করেন। অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠানের হয়ে নয়, বরং ব‌্যক্তিগতভাবে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান তারা।

মহাখালী, কমলাপুর, ফার্মগেট, মিরপুর, বিজয়নগর ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অনেকে মোটরসাইকেলসহ দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের সবাই আছেন যাত্রী পরিবহনের অপেক্ষায়। প্রতিটি মোটরসাইকেল হেলমেট আছে দুটি করে।

বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) রাতে রাজারবাগ ট্রাফিক সিগন‌্যালে সার্জেন্ট মো. রাজীব রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ইদানিং রাজধানীতে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে। পাঠাও-উবারের কারণে এ সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ছে। আগে যেখানে মিনিটে একটি মোটরসাইকেল সিগন‌্যাল পার হতো, এখন পাঁচটি পার হয়।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার কারণে অনেক লোক পরিবারের অন‌্য সদস‌্যদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়েছেন। ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে মেসে উঠেছেন বা একটি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকছেন। উপার্জনের জন‌্য রাইডি শেয়ারিং পেশা বেছে নিয়েছেন তারা। এরকম মানুষের সংখ্যা সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখের মতো হবে বলে একটি বেসরকারি সংগঠনের পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।

অন্যদিকে, ট্রাফিক পুলিশের এক হিসেবে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকাতে পাঠাও-উবারের অধীনে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন প্রায় ৩ লাখ বেকার। তাদের উপার্জনের প্রধান হাতিয়ার এই মোটরসাইকেল।