রাইজিংবিডি স্পেশাল

পদ্মা সেতু: স্বপ্ন এখন বাস্তব

কোটি কোটি বাঙালির স্বপ্নের অবকাঠামো পদ্মা সেতু। একসময় বাংলাদেশিদের কাছে যা স্বপ্ন ছিল, আজ তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ‌্যের পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান।

পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরুর আগে ছিল অনেক বাধা। ছিল অর্থ সংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় ঋণ প্রস্তাব বাতিল করেছিল বিশ্বব্যাংক। বিশ্বের অন্যতম খরস্রোতা নদী পদ্মা। এর তলদেশে মাটির স্তরের গঠনও জটিল। এসব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে পদ্মা সেতু। এমনকি করোনা পরিস্থিতিতে নির্মাণকাজ থেমে থাকেনি।

২০১২ সালের ২৯ জুন দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এ প্রকল্প থেকে সরে যায় এডিপি, জাইকা এবং আইডিবির মতো উন্নয়ন সহযোগীরাও।

বিশ্বব্যাংক প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ২০১২ সালের ৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ অধিবেশনে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে কোন কোন খাত থেকে পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় মেটানো হবে তা বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। পরদিন প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, প্রাথমিকভাবে দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হবে৷ এরপর কোনো দাতা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে চাইলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷

বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের পর দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্য, উপদেষ্টা এবং তৎকালীন সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াসহ অনেকের বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি বা তার পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন৷ 

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংক নিজেরা তদন্ত শুরু করে এবং তাদের তথ্যের ভিত্তিতেই তারা কানাডা পুলিশকে সে দেশের এসএনসি-লাভালিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে। পাঁচ বছরের বেশি সময়ের বিচার প্রক্রিয়া শেষে কানাডার আদালত ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সেই দুর্নীতির মামলা খারিজ করে দেয়। আদালত রায়ে বলেন, এ মামলায় যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেটা অনুমানভিত্তিক এবং গুজব।  ২০১৪ সালের নভেম্বরে শুরু হয় মূল সেতুর কাজ। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী মূল সেতুর নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছিল ২০১৫ সালে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের ১০ তারিখে বসানো হয়েছে সর্বশেষ স্প‌্যান। কয়েকটি পাইলিংয়ের গভীরতা বেশি হওয়ায় জার্মানি থেকে আনতে হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ৩ হাজার কিলোজুল শক্তিসম্পন্ন ৩৮০ টন ওজনের হ্যামার। 

মূল সেতু নির্মাণ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।

পদ্মা সেতুর প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘গত ১০ ডিসেম্বর সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসিকতা ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় আজ আমরা পদ্মা সেতুকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছি। দেশের নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেটা এখন প্রমাণিত।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এ সেতু নির্মাণ করার সময় নানা বাধা এসেছে। বিশেষ করে, গুজব ছড়ানো হয়েছে অনেক। অনেকে তা বিশ্বাসও করেছেন। এ নিয়ে সেতু কর্তৃপক্ষকে বিজ্ঞপ্তিও দিতে হয়েছিল। করোনা পরিস্থিতিতে এখানে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা একসঙ্গে কাজ করেছেন। কাজের গতি কম ছিল, কিন্তু বন্ধ হয়নি।‘ 

মূল পদ্মা সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি প্রায় ৯১ শতাংশ। এখন দোতলা আকৃতির সেতুর নিচের অংশে রেলওয়ে স্ল্যাব ও উপরের অংশে রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো হচ্ছে। ২০২২ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতু চালু হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

চলতি অর্থবছরেও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে পদ্মা সেতুর জন‌্য।  সর্বশেষ পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। তৃতীয় দফায় আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব‌্যয় বাড়ানো হয়। ফলে পদ্মা সেতুর ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। 

২০০৭ সালে একনেক ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল। পরে নকশা পরিবর্তন হয়ে দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে যায়। ২০১১ সালে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে আবারও ৮ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা বাড়ালে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। বাকি টাকা যাচ্ছে নদীশাসন ও অন‌্যান‌্য আনুসঙ্গিক কাজে। 

১৯৯৯ সালে সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটির প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ২০০৩-০৫ সালে জাইকার মাধ্যমে পরিচালিত সম্ভাব্যতা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে প্রকল্পটির মূল ডিপিপি গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি ২০০৭ সালে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৫ সালের মধ্যেই বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন করা হয়। এর পরে সময় বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। নদীশাসনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত হারে বাস্তবায়ন না হওয়ায় সময়সীমা আবার বাড়িয়ে করা হয় ২০২১ সালের জুন মাস।