রাইজিংবিডি স্পেশাল

এলডিসি থেকে উত্তরণ: বিশেষজ্ঞরা যা বললেন

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হতে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের দ্বারপ্রান্তে।  জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (ইউএন-সিডিপি) সভায় পর্যালোচনা শেষে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের সুপারিশ করা হয়েছে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর সুফল অনেক। পাশাপাশি বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে বাংলাদেশের। এজন্য এই বিষয়কেন্দ্রিক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন মেরুকরণ ঘটবে। এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে এসব বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর নিয়মিত হারে শুল্ক বসবে। তবে এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে রপ্তানি খাতে।

বর্তমানে এলডিসিভুক্ত হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও যুক্তরাজ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের মোট রপ্তানির ৬০-৬৪ শতাংশ ইউরোপের বাজারে। কিন্তু এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটার পর এসব দেশ ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের বিদ্যমান সুবিধা তুলে নেবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ উত্তরণ-পরবর্তী সর্বোচ্চ তিন বছর শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে।  ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য ও ইইউ ২০২৯ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এরপরই বাংলাদেশের এসব দেশে পণ্য পাঠাতে হলে হয় বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে, অন্যথায় অতিরিক্ত শুল্ক দিয়ে পণ্য প্রবেশ করাতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এনজিও থেকে অনুদান আসার পরিমাণ কমে যাবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে পোশাকশিল্প আজ এই সুদৃঢ় অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। তাই এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে রপ্তানি খাত। তবে এই অর্জনে আমাদের সম্মানের পাশাপাশি দায়িত্বও বাড়িয়ে দেবে। আমাদের আগামী ৫ বছর প্রতিযোগিতা নির্ভরতার জন্য নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, সল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের মাধ্যমে বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জল হবে। এর মাধ্যমে মানব উন্নয়নের অগ্রগতির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলো বাংলাদেশ।  ফলে পুঁজিবাজারসহ দেশের অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা আছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে বিদেশিরা সস্তিবোধ করবে। বিপরীত দিকে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আমরা যে বৈদেশিক সহায়তা পাই তার সুদ হার বাড়বে। শুল্ক মুক্ত রপ্তানি সুবিধা থাকবে না। ফলে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্য করতে হবে। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ রাইজিংবিডিকে বলেন, সল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ হওয়া একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এর ফলে দেশের সম্মান বাড়বে। বিশ্বে ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ প্রসারিত হলো। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। সল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ হওয়ার কারণে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বাংলাদেশ।  এর মধ্যে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে। বিশেষ করে রফতানি খাতে এ চ্যালেঞ্জ বেশি। ফলে তৈরি পোশাক খাত, ওষুধ খাতসহ অন্যান্য খাতে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে হবে।  মোট কথা টেকসই উন্নয়নে জোর দিতে হবে। এর মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, এই খাতকে ঘিরে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা না করে এলডিসি থেকে বের হওয়া যাবে না। আর এজন্য এখনই কাজ শুরু করতে হবে।

তিনি বলেন, আগামীতে এ বিষয়ে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এলডিসি হিসেবে যেকোনো দেশ তার দেশে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন কৃষি ও শিল্প খাতের নানা পণ্য বা সেবায় ভর্তুকি দেয়। এসব ভর্তুকি ও নগদ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করার চাপ আসতে পারে।  এমনকি বাংলাদেশ এখন যে রপ্তানি আয় বা রেমিট্যান্স আনায় নগদ সহায়তা দেয়, তা নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে।

এলডিসি থেকে বের হওয়ার নিয়ম এলডিসি থেকে কোনো দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে সিডিপি। এজন্য প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়।

সিডিপি পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে এসব মান অর্জন করলেই এলডিসি থেকে বের হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ করে সিডিপি।  সিডিপির সুপারিশ প্রথমে জাতিসংঘের ইকোসকে যায়। তিন বছর পরে তা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অনুমোদনের জন্য ওঠে। কিন্তু করোনার কারণে বাংলাদেশ বাড়তি আরও দুই বছর সময় পেল। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বের হবে বাংলাদেশ।