রাইজিংবিডি স্পেশাল

৭ কলেজের সংকট সমাধানে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ‌্যালয়ের পরামর্শ, তবে...

ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্ত ৭ কলেজের সংকট স্থায়ীভাবে নিরসনে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ‌্যালয় গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, এই ৭ কলেজ নিয়ে আলাদা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে। আর এই এজন‌্য কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও তৈরি করতে হবে। তাহলে আর কোনো ঝামেলা থাকবে না। তবে কেউ বলছেন, কলেজগুলো নতুন করে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে গেলে ঝামেলা বাড়তে পারে। সম্প্রতি ঢাবি অধিভুক্ত কলেজগুলোয় সৃষ্টি জটিলতার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ‌্যে তারা এই পরামর্শ দেন।

এর আগে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট কমাতে অধীনস্থ কলেজগুলোকে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। ওই বছরই ঢাবির অধিভুক্ত করা হয় রাজধানীর বড় সাতটি কলেজকে। শিক্ষাবিদদের অভিযোগে, ৩ বছর পর দেখা যাচ্ছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি কলেজগুলোর চেয়েও পিছিয়ে পড়েছে এই কলেজগুলো।

সংকট সমাধানে এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় নেমেছেন। সর্বশেষ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি চলমান পরীক্ষা স্থগিতের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে তারা। দিনভর আন্দোলনের স্থবির হয়ে যায় পুরো রাজধানী। জরুরি বৈঠক ডাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একদিনের মধ্যে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নতুন রুটিনও প্রকাশ করে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। রুটিন পেয়ে বাসায় ফিরে গেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে, একের পর এক সংকট নিরসনে নতুন দাবি তুলছেন কেউ কেউ।

পারভেজ খান তন্ময় নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘৭ কলেজের ছাত্রদের একটাই স্বপ্ন, এই কলেজগুলো নিয়ে আলাদা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করতে হবে। যার নাম হতে পারে ‘৭ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়’। বিকল্পে কোনো মহান মানুষের নামে হতে পারে কিংবা হতে পারে সৃজনশীল কোনো নামেও। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭টি ক্যাম্পাস থাকবে। স্বতন্ত্র জায়গায় থাকবে প্রশাসনিক ভবন। ৭ টি ক্যাম্পাসের নাম বর্তমান কলেজের নামেই হবে।’

আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ছোট্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে আজকের এই অবস্থানে এসেছে। যেখানে আমারা ৭ কলেজ সংখ্যায় অনেক বড়। ঢাবির ছাত্ররা ৭ কলেজের সঙ্গে প্রতিহিংসায় লিপ্ত। তাই যতদিন স্বায়ত্তশাসিত না হবে, ততদিন সেশনজট দূর হবে না। আমাদের যা যাওয়ার গেছে, আগামীতে যেন এমনটা আর না হয়।’  

জানতে চাইলে ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু বকর বলেন, ‘কাউকে না কাউকে ঝামেলা পোহাতে হবে। আমরা হয়তো সে ঝামেলাটা পোহাচ্ছি। তবে অধিভুক্ত হওয়ার পর যারা ঢাবির অধীনে ভর্তি হয়েছে, তারা ভালো আছে। তাই বলবো অধিভুক্ত থাকলে সমস্যা নেই। তবে যেন সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সতর্ক থাকে, সে অনুরোধ রইলো। ’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সময় সাত কলেজকে ঢাবির অধিভুক্ত করা হয়। শিক্ষার্থীদের বারবার অসন্তোষ ও রাস্তায় নেমে আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনোভাবেই যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, জনগণের ক্ষতি না হয়, তা মাথায় রেখে শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ের আন্দোলন সংগ্রাম করবেন। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও উচিত, তাদের পরীক্ষা যথাসময়ে নেওয়া। ফল প্রকাশ করা। যেন তাদের মনে কোনো অসন্তোষ তৈরি না হয়।’

শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র শাসন ব্যবস্থার দাবির বিরোধিতা করে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘ঢাবি একটি শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের অন্যতম অংশীদার। আলাদা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে থাকা ৭ কলেজের জন্য অনেক গৌরবের।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রথমত কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া হুট করে এই কলেজগুলোকে ঢাবিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত ছিল মারাত্মক ভুল। একটা পরিস্থিতি দাঁড় করিয়ে তারপর তাদের একটি নির্দিষ্ট বর্ষ থেকে অধিভুক্ত করা যেতে পারতো। একইসঙ্গে এর জন্য পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগও দরকার ছিল’ তিনি বলেন, ‘এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো যেতে পারে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের সার্টিফিকেট দেবে, সেটা ঠিক আছে। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে এমন অনেক নজির রয়েছে। আমাদের দেশে অনেক গবেষক আছেন। তাদের এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে মন্ত্রী, এমপির আত্মীয় স্বজনরা এসব প্রতিষ্ঠানে রয়ে গেছেন। তাদের বদলি করে বিভিন্ন গবেষককে এখানে সংযুক্ত করা যেতে পারে।’

ড. মিজান আরও বলেন, ‘এসব প্রতিষ্ঠানে এইচএসসি স্তর থাকলে সেগুলো বাদ দিয়ে আপাদমস্তক উচ্চতর ডিগ্রির জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রস্তুত করতে হবে। তাহলে বিরাট চেঞ্জ আসবে। এছাড়া এত বিশাল অংশের ছাত্রদের ঢাবির নিজস্ব প্রশাসনের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাবির সিলেবাস ফলো করতে বলতে পারে।কিন্তু তাদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।’

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. একরামুল কবির বলেন, ‘মূলত হুট করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢাবির অধীনে নিয়ে আসা ছিল চরম ভুল। এর ক্ষতির শিকার হচ্ছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। এখন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে, সম্পূর্ণ আলাদাভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের জন‌্য স্বতন্ত্র পরিচালনা পর্ষদ থাকবে। যেখানে তারা ঢাবির সিলেবাস, রুলস মানবে। কিন্তু প্রশাসনিকভাবে সম্পূর্ণ আলাদা পরিচালিত হবে। তবে, আলাদাভাবে কলেজগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান করার সুযোগ নেই। এটি প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, ‘২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি ৭ কলেজ নিয়ে একটি প্রতিবেদন পাস হয়েছে। সেখানে একজন উপ-উপাচার্যকে প্রধান করে পৃথক পরিচালনা পরিষদের সুপারিশ করা হয়। এরই ভিত্তিতে ২০২১ সালে এসে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামালকে ৭ সরকারি কলেজের প্রধান সমন্বয়ক করা হয়েছে। ৭ কলেজের জন্য একটি পৃথক ইউনিটও গঠন করা হয়েছে। তবে, তা অনেক শিক্ষার্থী জানেন না।’

ড. সামাদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের স্বার্থে বলতে চাই, সবকিছুই সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই আমরা কাজ করছি।’

প্রসঙ্গত, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসার পর কলেজগুলোতে যখনই একটি শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছিল; তখনই করোনা মহামারি তাদরে ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে। এই সাতটি কলেজ হলো, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।