রাইজিংবিডি স্পেশাল

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে যা বলছেন শিক্ষাবিদ-চিকিৎসকরা 

করোনার সংক্রমণ রোধে সরকারের নির্দেশে গত একবছর ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। সম্প্রতি সংক্রমণ-মৃত‌্যুর হার কিছুটা কমে আসায় আগামী ৩০ মার্চ থেকে স্কুল-মাদ্রাসা-কলেজ-বিশ্ববিদ‌্যলয় খুলে দেওয়ার উদ‌্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু ইতোমধ‌্যে করোনার রোগী শনাক্ত ও মৃত‌্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় যথাসময়ে  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে নতুন করে ভাবছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই আলোকে করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকলে  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে দেরি হতে পারে গত ১২ মার্চ জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এই ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদ, অভিভাবক ও চিকিৎসকরা।  তবে, কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করছেন।

শিক্ষাবিদ, অভিভাবক ও চিকিৎসকরা বলছেন, গত তিন মাসে করোনা সংক্রমণ একটু কমলেও এখন বাড়ছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। সময় পেলেই তারা বিভিন্ন জায়গায় দলবেঁধে, গাঁ-ঘেষে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ভ্রমণে যাচ্ছেন। গণজমায়েত করছেন। ফলে করোনা সংক্রমণ বাড়ছেই। 

রাজধানীর উত্তরার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মীম (ছদ্মনাম)। তার মা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। প্রায় এক বছর ধরে স্কুল বন্ধ। করোনা সংক্রমণের প্রথম দিকে একটু বাসায় পড়তে বসতো। এখন তেমন বসে না। ছোট মানুষ, কিছু বলিও না। সবসময় বলে, কবে স্কুল খলবো আর বান্ধবীদের সঙ্গে খেলবো। আমরা গরিব মানুষ, পড়ালেখা ছাড়া আর তো কোনো সম্পদ নেই। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে স্কুল যেন খুলে দেয় সরকার।’

মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পাঁচ্চরে একটি মাধ্যমিক স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে সিহাব। তার মা বলেন, ‘আমার ছেলের এখন পড়ানেহা নাই। খালি বন্ধুগো লগে গ্রামে গ্রামে ঘুইরা বেড়ায়। সরকার ছোটগো টিকা দিক, তারপর স্কুলে নিক। এমনে তো পোলাহান নষ্ট হইয়া যাইবো।’ জানতে চাইলে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডাক্তার জি কে এম শহীদুজ্জামান বলেন, ‘আমার কাছে কয়েক দিন আগে গ্রাম থেকে একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক এসেছেন, তাকে প্রশ্ন করেছি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার সন্তান পাঠানোর ব্যাপারে। তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই সন্তানকে  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে চান।’

সংক্রমণ বাড়লে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার তারিখ পেছানোর সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক মনে করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, ‘শিশুদের হয়তো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, তারা করোনা সংক্রমিত হলে অনেক সময় তাদের মধ্যে কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। কিন্তু তারা যখন বাড়িতে যাবেন, তাদের পরিবারের প্রবীণ সদস্যরাও আক্রান্ত হতে পারেন। এজন্য তাদের  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া প্রয়োজন।’

ডা. রোবেদ আমিন আরও বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ যখন ৫ শতাংশের চেয়ে বেশি হবে, তখন প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে নিষেধ করা আছে। আর এখন পর্যন্ত ১৬ বছরের নিচের শিশুদের জন্য কোনো ভ্যাকসিনই তৈরি করা হয়নি। তবে, ইতোমধ্যে অক্সফোর্ড বাচ্চাদের উপযোগী করে ভ্যাকসিন প্রস্তুত করছে। আশা করি, দ্রুত বাচ্চারা ভ্যাকসিন পাবে। তখন হয়তো তাদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যাবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ আ আ ম স আরেফিস সিদ্দিক বলেন, ‘আসলে করোনা সংক্রমণের ওপর নির্ভর করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা বা না খোলার বিষয়টি। এখন দেখছি কিছু দিন যাবত করোনা সংক্রমণের হার অন্য দেশগুলোতে বাড়ছে। আমাদের দেশেও বাড়ছে। এক্ষেত্রে বলবো, আগামী ৩০ মার্চ যেহেতু বাচ্চাদের স্কুল খোলার কথা বলা হয়েছে, সেক্ষেত্রে আরও অনেক সময় বাকি। যদি করোনা সংক্রমণ বাড়ে, তাহলে হয়তো খোলা দেরিতে হতে পারে। আর কমলে তো ঘোষণা দেওয়া আছে। তখন আশা করি.  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে।’

আ আ ম স আরেফিস সিদ্দিক আরও বলেন, ‘অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। তারা বিভিন্ন জায়গায় অসচেতনভাবে ভ্রমণ করছেন, চলাফেরা করছেন, সভা-সেমিনার করছেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠান করছেন। করোনার সময় এটা বে-আইনি। স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণেই করোনা সংক্রমণ বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। এই সময়ে  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের দিতেই চান না অনেক অভিভাবক।’

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান নেহাল আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা বলেছিলেন, তখন করোনা পরিস্থির কথাও বলেছিলেন।’ তিনি বলেছিলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগামী ৩০ মার্চ থেকে ধীরে ধীরে খোলা হবে। এখন করোনা সংক্রমণ একটু বেড়েছে। ৩০ মার্চ আসতে অনেক সময় বাকি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অবশ্যই নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইলেই খুলতে পারবে না, খোলার ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি প্রয়োজন। কারণ, করোনা পরিস্থিতি কেমন, এটা তো জানাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।’ 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সব প্রস্তুতি নেওয়া রয়েছে উল্লেখ করে নেহাল আহমেদ আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে একটা বড় অংশ আমাদের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের করোনার ভ্যাকসিন (প্রথম ডোজ) নেওয়া হয়েছে, বাকিরাও নিচ্ছেন।’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগে এই প্রস্তুতি শেষ হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।