রাইজিংবিডি স্পেশাল

রানা প্লাজা ধস: সহস্রাধিক শ্রমিক হত্যার বিচারে স্থবিরতা

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জন নিহত হন। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই হত্যা মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। চার্জ গঠনের পর পাঁচ  বছরেও এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণই শুরু হয়নি।

বিচারিক আদালতের চার্জ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে উচ্চতর আদালতে আবেদন করে আসামিপক্ষ। আর কয়েকজন আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকাতেই মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আইনি জটিলতায় স্থবির হয়ে আছে মামলাগুলো। কবে মামলাটির সাক্ষ্য শুরু হবে বলতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ।

রানা প্লাজা ধসের পরপরই বেশ কয়েকটি মামলা হলেও মূল মামলা দুটি। এর একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে। অপরটি ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন তৈরির। দুই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে থাকলে অধিকাংশ আসামি জামিনে এবং পলাতক রয়েছেন। দীর্ঘ ৮ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত মামলার বিচারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

মামলা দায়েরের দু’বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ১ জুন তদন্ত শেষে পৃথক দুটি চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর। যার একটিতে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানা ও তার বাবা-মা এবং তৎকালিন সাভার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনারসহ ৪১ জনকে এবং অপরটিতে ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়।

দুটি চার্জশিটে মোট আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুটি মামলারই আসামি। এ দুটি মামলায়ই পৃথক দুই আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন। তবে দুটি মামলাতেই আসামিপক্ষ চার্জ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করায় এবং কয়েকজন আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া রানা প্লাজা নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে পৃথক আরেকটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। ২০১৭ সালের ২১ মে এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধ চার্জ গঠন করেন আদালত।

রানা প্লাজার হত্যা মামলা রানা প্লাজা ধসের পরদিন অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার এসআই আলী আশরাফ। ওই মামলায় সোহেল রানাসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া রানা প্লাজা ধসে নিহত হওয়ার ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড আখ্যায়িত করে আদালতে আরেকটি মামলা করেন গার্মেন্টস শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলি আক্তার। আদালতের নির্দেশে একে অবহেলাজনিত মৃত্যু মামলার সঙ্গে একীভূত করে তদন্ত করে সিআইডি। আদালতে দায়ের করা হত্যা মামলার বাদী শিউলি আক্তার এখন পুলিশের মামলার সাক্ষী। এ মামলায় মোট ৫৯৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। চার্জশিটভুক্ত ৪১ আসামিদের মধ্যে সোহেল রানা কারাগারে। রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বকর সিদ্দিক ও আসামি আবুল হোসেন জামিনে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। বর্তমানে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ শওকত আলী চৌধুরীর আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।

এ সম্পর্কে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এডিশনাল পাবলিক প্রসিউকিউশন মো. মিজানুর রহমান বলেন, হত্যা মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু মামলাটিতে দুই আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অনেকবার সাক্ষী হাজির করা হয়েছে। তারপরও সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এটর্নী জেনারেল কার্যালয় বরাবর চিঠিও দেয়া হয়েছে। তারপরও কিছু হয়নি। আশা করছি উচ্চ আদালতের অনুমতি পেলেই বিচারকার্য দ্রুত শুরু করতে পারবো।

রানার আইনজীবি ফারুক আহাম্মদ বলেন, রানা গত ৮ বছর ধরে জেল হাজতে রয়েছে। দুই আসামির পক্ষে হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ থাকায় মামলার কার্যক্রম এগোচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে স্থগিতদেশ ভ্যাকেট করে মামলার কার্যক্রম শুরু করতে পারে। মামলার রায়ে যা হওয়ার তাই হবে। এভাবে বিনা বিচারের ৮ বছর জেলে থাকা মানবিক দিক থেকে অন্যায়। তাই রাষ্ট্রপক্ষের উচিত স্থগিতাদেশ কাটিয়ে দ্রুত বিচারের দিকে এগিয়ে যাওয়া।  

তিনি বলেন, একমাত্র রানায় জেল হাজতে রয়েছে। বাকি সবাই জামিনে রয়েছেন। আশা করি রায়ে তিনি খালাস পাবে, কারণ এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র।

ইমারত আইনের মামলা ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে ওই সময় সোহেল রানাসহ ১৩ জনকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় আরেকটি মামলা করেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা  মো. হেলাল আহমেদ। সিআইডি তদন্ত শেষে এ মামলায় সোহেল রানা ও তার বাবা-মা সহ ১৮ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ১২ ধারায় এ চার্জশিট দাখিল করে। এ মামলায় ১৩৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য রয়েছে। চার্জগঠনের আদেশের বিরুদ্ধে কয়েকজন আসামি রিভিশন করায় মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ হচ্ছে।

মামলায় ১৮ আসামির মধ্যে সোহেল রানা কারাগারে রয়েছে। পাঁচ আসামি পলাতক আর বাকিরা জামিনে আছেন।

ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা সম্পর্কে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের কৌঁসুলী আনোয়ারুল কবীর বাবুল বলেন, ‘কয়েকজন আসামি চার্জগঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন আবেদন করেন। এদের মধ্যে এক আসামির রিভিশন মঞ্জুর করেছেন আদালত। রিভিশনের বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যাবে।’

নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণে দুদকের মামলা রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর পরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুদক। নকশাবহির্ভুত ভবন নির্মাণের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৫ জুন সাভার থানায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে এই মামলাটি করে কমিশন। ভবনটি সোহেল রানার বাবার নামে হওয়ায় ওই সময় মূল অভিযুক্ত সোহেল রানাকে বাদ দিয়েই তার বাবা-মাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়। তদন্তে সোহেল রানাই ভবনের মূল দেখ-ভালকারী ছিলেন প্রমাণ হলে চার্জশিটে তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক এসএম মফিদুল ইসলাম ওই বছরের ১৬ জুলাই সোহেল রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০১৬ সালের গত বছরের ৬ মার্চ দুদকের দেয়া  চার্জশিটে ত্রুটি থাকায় আদালত তা গ্রহণ না করে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। দুদক পুনরায় তদন্ত করে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে আদালতে ফের চার্জশিট দাখিল করে। নতুন চার্জশিটেও রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৯ জন মারা যায়। ধ্বংসস্তূপ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। মৃত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ৮৪৪ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা রেখে ২৯১ জনের অসনাক্তকৃত লাশ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। জীবিত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ১ হাজার পাঁচ’শ ২৪ জন আহত হন। তদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন ৭৮ জন।