রাইজিংবিডি স্পেশাল

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর: প্রাধান্য পাবে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা

প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার ভারত সফর ঘিরে প্রতিবারই উত্তাপ থাকে প্রতিবেশী দুই দেশে। এবারও এমন একটি সময়ে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাচ্ছেন যখন চীন ইস্যু, তিস্তা ইস্যু, নির্বাচন, রাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে।

কূটনীতিকরা বলছেন, এই সফরে যুগান্তকারী বড় ধরনের কোনো চুক্তি হবে না। তবে এই সফর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এরই মধ্যে উভয়দেশ প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরের চূড়ান্ত সময়সূচি এবং সফরসূচি প্রকাশ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয়াদিল্লি সফর করবেন।  আশা করা হচ্ছে, এই সফরে পাঁচ থেকে সাতটি স্মারক সই হতে পারে।

আলোচনায় রাজনৈতিক ইস্যু: বাংলাদেশের চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার যে প্রবণতার কথা ভারতের কূটনৈতিক মহল থেকে বলা হচ্ছে তা প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে পরিষ্কার করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ তবে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কথা হলেও তিস্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরেও কিছু হচ্ছে না৷ কুশিয়ারার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি হতে পারে, গত মাসে ভারতে অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে তা স্পষ্ট হয়েছে।

আগামী বছরের শেষদিকে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে৷ তাই আগামী নির্বাচনের আগে এটাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ভারত সফর বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দিক দিয়ে শেখ হাসিনার এই ভারত সফরকে গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষকেরা দেখছেন। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যে দুই দেশের সরকারই কিছুটা বিব্রত পরিস্থিতিতে রয়েছে বলে কূটনীতিকরা মনে করছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের সফরে বাংলাদেশ চাইছে যে দুই দেশের মধ্যে যে সর্বোচ্চ সম্পর্ক তা আরও একবার নির্বাচনের আগে প্রমাণ করা৷ আর সেজন্য বাংলাদেশের দিক দিয়ে সেপা চুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে৷পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে৷আর ভারতে যে একটি মনোভাব তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তা দূর করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ শেখ হাসিনা ৫ সেপ্টেম্বর ভারত গিয়ে সেখানকার কূটনীতিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন৷ দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাস এ আয়োজন করেছে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক অবশ্যই ভিন্ন গুরুত্ব বহন করে। ভারতের সাথে আমাদের নিয়মিত আলাপ আলোচনা হয়৷ প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে চীন ইস্যু থাকা স্বাভাবিক। আর নির্বাচনের কারণে রাজনৈতিক বিষয় আলোচনায় থাকবে।

সম্ভাব্য চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষর: ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চুক্তি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে যেসব বিয়য় আলোচনায় আসবে তার মধ্যে রয়েছে- সামরিক সরঞ্জাম কেনা৷ এ নিয়ে ২০১৯ সালে চুক্তি হয় ভারতের সাথে৷ ভারত  ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে৷ওই ঋণের আওতায় ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম কিনবে বাংলাদেশ৷ গত জুলাইয়ে ভারতের সেনাপ্রধানের ঢাকা সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন৷ সাক্ষাতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় বলে জানা গেছে।

মেরিটাইম সিকিউরিটির জন্য ভারত থেকে রাডার ক্রয় নিয়েও এই সফরে আলোচনা হতে পারে বলে জানা গেছে৷ উপ-আঞ্চলিক এনার্জি হাব গঠন নিয়ে কথা হবে৷ আর সেটা হলো বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটানকে নিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প৷এর নেতৃত্বে রয়েছে ভারত৷ বাংলাদেশ নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আনতে চায়৷ একই সঙ্গে এই অঞ্চলে জ্বালানি নিরাপত্তা কানেকটিভিটি বিষয়টি নিয়ে যৌথভাবে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ৷ এই সফরে নেপালের জিএমআর কোম্পানির সঙ্গে ভারতের ওপর দিয়ে জলবিদ্যুৎ আমদানি সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হতে পারে।

এবার সফরের অর্থনেতিক বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তি, সেপা (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট)৷ এই চুক্তি হলে ভারত ও বাংলাদেশের পণ্য দুই দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা পাবে৷বাংলাদেশ এরই মধ্যে এই চুক্তি অনুমোদন করেছে৷ এর সঙ্গে বাংলাদেশ এন্টি ডাম্পিং নীতি নিয়েও আলোচনা হতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, দুদেশের স্টাফ কলেজের মধ্যে সহযোগিতা, বিচার বিভাগীয় সহযোগিতা ও কুশিয়ারা নদীর পানি উত্তোলন নিয়ে সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। এছাড়া নবায়নের মধ্যে রয়েছে সুনীল অর্থনীতি বিষয়ক সমঝোতা স্মারক এবং বাংলাদেশ টিভি ও প্রসার ভারতের মধ্যে সমঝোতা স্মারক। এছাড়া রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের দুটি সমঝোতা স্মারক নিয়ে আলোচনা চলছে। এছাড়া সফরে রূপসা নদীর ওপর ব্রিজ হস্তান্তরসহ আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে কাজ চলছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফর নিয়ে বৃহস্পতিবার (১ সেপ্টেম্বর) আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রকাশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফর উভয়দেশের জন্যই তাৎপর্যপূর্ণ। আশা করা হচ্ছে, তার এই সফরের মাধ্যমে দুই বন্ধুপ্রতীম দেশের মধ্যে সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচন হবে।

সফরসূচি: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয়াদিল্লি সফর করবেন। প্রধানমন্ত্রী একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। যার মধ্যে থাকছেন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এ সফরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে থাকবেন।

সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানাবেন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, সে সময় তাকে আনুষ্ঠানিক গার্ড অব অনার দেওয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৫ সেপ্টেম্বর দিল্লি পৌঁছাবেন। সেদিন দিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাসে ভারতীয় অতিথিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হবেন।

দিল্লি সফরের দ্বিতীয় দিন ৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করবেন। তার আগে তিনি দিল্লির রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেবেন শেখ হাসিনা। সফরকালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় বেশ কয়েকটি চুক্তি এবং সমঝোতা স্বাক্ষর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সফরকালে আগামী ৭ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্য বক্তব্য দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই দিন বিকেলে আজমীর শরিফে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির মাজার জিয়ারত করবেন তিনি। পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর জয়পুর শহর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।