রাইজিংবিডি স্পেশাল

‘কলের গান’ এখন দূর অতীত

আনোয়ার হোসেন শাহীন মাগুরা, ৫ মে : এখন মোবাইল আর সিডি’র যুগ। বর্তমান প্রজন্মের কাছে গ্রামোফোন বা কলের গান একেবারেই অচেনা। দূর অতীত। ফুরিয়ে যাচ্ছে ক্যাসেটের দিনও। সিডিরও (কমপ্যাক্ট ডিস্ক) বিদায়ের সুর। তরুণরা এখন গান শোনে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও এমপি থ্রি প্লেয়ারে। জানা যায়, শব্দ সংরক্ষণের জনক টমাস আলভা এডিসন। তিনি ১৮৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কাঠের বাক্সের ওপর চোঙা লাগানো এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করলেন । যার মধ্যে গোলাকৃতি এক বস্তুর ওপর চাকতির মধ্যে পিন লাগিয়ে ঘোরালে শব্দ উৎপন্ন হয়। এডিসন তার প্রিয় কবিতা ‘মেরি হ্যাড এ লিটল ল্যাম্প’ পাঠ করে রেকর্ডে ভরে উদ্বোধন করলেন যন্ত্রের। নাম দিয়েছিলেন ‘ফনোগ্রাফ। বছর দশেক পর জার্মানির বিজ্ঞানী বার্নিলার টিনফয়েল আধুনিক করে মোমের রেকর্ড বানিয়ে নাম দেন গ্রামোফোন। তারপর মাটির রেকর্ড থেকে প্লাস্টিকের সুতায় ঘূর্ণন রেকর্ড। এডিসনের পোষা প্রিয় কুকুরকে গ্রামোফোনের চোঙের সামনে বসিয়ে মনোগ্রাম করে নামকরণ হয় ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ সংক্ষেপে এইচএমভি। ১৮৯৮ সালে জার্মানিতে গড়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম গ্রামোফোন কোম্পানি। গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মাগুরাসহ অনেক বনেদী পরিবারে গ্রামোফোন বাজত। এখন পুরনো কয়েকটি পরিবারের ড্রয়িংরুমে শো-পীচের জায়গা দখল করে আছে দু-একটি গ্রামোফোন রেকর্ড।

গ্রামোফোনে গান শুনেছেন এমন প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ‘দ’ আকৃতির একটি হ্যান্ডেল দিয়ে স্প্রিং চেপে রেখে নরম কাপড়ে মোড়ানো গোলাকার চাকতির ওপর রেকর্ড বসানোর পর ছোট মোটা গোলাকৃতি সাউন্ড সিস্টেমের ভিতর ছোট্ট পিন বসিয়ে রেকর্ড ঘুরিয়ে তার ওপর চেপে দিলেই গান বাজত। রেকর্ড চলার সময় স্প্রিং ধীরে ধীরে ফুলে উঠলে ফের পাম্প করতে হতো। রেকর্ড ঘূর্ণন কম হলে কণ্ঠের হেরফের হতো। রেকর্ড জোরে ও আস্তে ঘোরানো যেত। জোরে ঘোরালে কথা ও সুর এতই দ্রুত হতো যে হাসি পেত। আস্তে ঘোরালে উল্টো। পাম্প কমে গেলে কথা ও সুর হতো একেবারে ধীর গতিতে। ষাটের দশকে বেতারে গান প্রচারের সময় ঘোষক বলতেন ‘এখন শুনবেন গ্রামোফোন রেকর্ডে গান।’ আন্দামান ও ভারত মহাসাগরকে অতিক্রম করে এই উপমহাদেশে কলের গানের প্রথম আগমন ঘটে ভারতের বোম্বে (মুম্বাই) ও কলকাতায়। তারপর আসে বাংলাদেশে। কে প্রথম  গ্রামোফোন আনেন এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ১৮৯৫ সালে স্বামী বিবেকানন্দ তার বন্ধুর কাছ থেকে গ্রামোফোন উপহার পান। কলকাতার বেলিয়াঘাটায় এশিয়ার প্রথম রেকর্ড কারখানা স্থাপিত হয় ১৯০৮ সালের ১৯ জুন। সেখানে গ্রামোফোন যন্ত্র ও খুচরা পার্টসও তৈরি হতো। গান পিপাসুদের জন্য রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, বাংলা গীত, নাটক, কৌতুক সবই রেকর্ড হতে থাকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নিজের কণ্ঠের গান রেকর্ড করা হয়। তখন বেশির ভাগ রেকর্ড ছিল প্রতি মিনিটে ৭৮ বার ঘূর্ণনের। এই রেকর্ডকে বলা হতো ৭৮ আরপিএম (রিভলভিং পার মিনিট)। এইচএমভি, কলাম্বিয়া, টুইন কোম্পানির রেকর্ড চলত বেশি। ঐতিহাসিক পালা সিরাজউদ্দৌলা, চাঁদ সওদাগর, শৈলজানন্দের শহর থেকে দূরে নাটকের রেকর্ড ব্যাপক প্রচার পায়। তবে উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশি চলে বাট শেফার্ডের হাসির গানের রেকর্ড। ৫ লাখ কপি বিক্রি হয়। ওই সময় রেকর্ডের দুই পিঠে একটি করে গান থাকত। দেশে সত্তরের দশকের প্রথমেও রেকর্ড ছিল। ছোট রেকর্ড থেকে তৈরি হলো লং প্লে রেকর্ড। এক রেকর্ডে দুই পিঠে ৭/৮ টি করে গান।

গ্রামোফোনের বদলে এল ৪৫ আরপিএমের (ছোট রেকর্ড) রেকর্ড প্লেয়ার। তারপর অটো রেকর্ড প্লেয়ার, চলত ব্যাটারি ও বিদ্যুতে। সেই সঙ্গে বড় ফিতার স্পুল রেকর্ডার। বলা হতো টেপ রেকর্ডার। আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত ছোট ফিতার ক্যাসেট রেকর্ডার। একটি ক্যাসেট এপাশ-ওপাশ মিলে চলত এক ঘণ্টা। গান শোনার ক্যাসেটের সঙ্গে চলে এলো ভিডিও ক্যাসেট। তারপর শব্দ বিজ্ঞানের পালা বদল ঘটতে থাকে সুপারসনিক গতিতে। একবিংশ শতকের প্রথম দিকেও ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল। দ্রুত বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেল ক্যাসেট। এলো কমপ্যাক্ট ডিস্ক (সিডি)। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এলো ডিজিটাল ভিডিও ডিস্ক (ডিভিডি)। গান স্থির ছবি, চলমান ছবি সবই ডিস্কে ধরে রাখার ব্যবস্থা।বিবর্তনের পালায় এই ছোট্ট জিনিসও বোঝা হয়ে গেল। হাতের মুঠোয় পেন ড্রাইভে সবই ধরে রাখার ব্যবস্থা করল বিজ্ঞান। এই পেন ড্রাইভ চালাতে লাগে কম্পিউটার। অত সময় কোথায়। পরে বিজ্ঞান সবই ঢুকিয়ে দিল সেল (মোবাইল) ফোনে। হাতের মুঠোয় এখন বিশ্ব। ইন্টারনেটও ভেসে ওঠে সেলফোনে। সেখানে গান শোনা, স্থির ও চলমান ছবি তোলা ও দেখা তো এখন নস্যি। বর্তমান প্রজন্ম চলতে ফিরতে মোবাইলের মনিটরে সবই দেখে। গানও শোনে। মধ্য বয়সীদের সেলফোনেও এখন পুরনো দিনের গান বাজে। শহরের মোবাইল ফোনের মার্কেটগুলোতে কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকে গান ও ভিডিও ছবি তুলে দেয়ার অপারেটররা। প্রতিগান এক টাকারও কম। একসঙ্গে বেশি নিলে পাইকারি দর। এ জন্য মোবাইল ফোন রেখে যাওয়ারও দরকার নেই। বোতামের চেয়ে পাতলা মেমোরি কার্ড বের করে কয়েক মিনিটের মধ্যে গান তুলে দেয়া যায়। পুরনো ও নতুন গান, ছায়াছবির গান এখন হাতের মুঠোর মধ্যে বাজে।

মাগুরার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থের লেখক সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, তরুণ প্রজন্ম গ্রামোফোন রেকর্ড কী জানেনা । মাগুরায় এখনো কয়েকটি গ্রামোফোন রেকর্ড রয়েছে। তরুণ প্রজন্মকে শব্দ বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত করতে এগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

 

রাইজিংবিডি/শাহ মতিন টিপু