রাইজিংবিডি স্পেশাল

বৈশ্বিক মন্দাতেও সুবিধাবঞ্চিতদের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার

বিদায় নিচ্ছে ২০২২ সাল। এ বছর করোনাভাইরাস মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যখন বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা, তখন সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ সরকার। নানা প্রণোদনা ও ভাতা দিয়ে নাগরিকদের জীবনযুদ্ধকে কিছুটা সহজ করার চেষ্টা করা হয়েছে সরকারিভাবে।

বয়স্ক ভাতা দুস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম অথবা উপার্জনে অক্ষম বয়স্ক মানুষদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধান এবং পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধিতে কাজ করছে সরকার। বয়স্ক ভাতাভোগী নারীদের বয়স ৬৫ বছর থেকে কমিয়ে ৬২ বছর করা হয়েছে। উপকারভোগী নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ডাটাবেজ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১০ টাকার বিনিময়ে সব ভাতাভোগীর নামে ব্যাংক হিসাব খুলে ভাতার অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। ৫৭ লাখ ১ হাজার বয়স্ক ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ আছে ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।

বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারীদের ভাতা কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়। ওই অর্থবছরে ৪ লাখ ৩ হাজার ১১০ জনকে এককালীন মাসিক ১০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হয়। ২০০৩-০৪ অর্থবছরে এ কর্মসূচি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। এ কর্মসূচির আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৪ লাখ ৭৫ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাকে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার ৪৯৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বর্তমানে সব উপকারভোগীকে মাসিক ভাতা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার নগদ, বিকাশের মাধ্যমে  জিটুপি (গভর্মেন্ট টু পারসন) পদ্ধতিতে দেওয়া হচ্ছে।  ভাতা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো—বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান। পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা। আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে তাদের মনোবল জোরদার করা। চিকিৎসা সহায়তা ও পুষ্টি সরবরাহ বৃদ্ধিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান।

প্রতিবন্ধী ভাতা বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রদানে বদ্ধপরিকর। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা ২০ লাখ ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৩ লাখ ৬৫ হাজার জন করা হয়েছে। মাসিক ভাতার হার ৭৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮৫০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতা খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ২ হাজার ৪২৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা।    

ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট: সরকার অবহেলিত এতিম শিশুদের প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণে বদ্ধপরিকর। এতিম শিশুদের লালনপালনের জন্য বেসরকারিভাবে এতিমখানা পরিচালনা করা হয়ে থাকে। বেসরকারি এসব এতিমখানা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে সহযোগিতা করা হয়।    বর্তমানে ৪ হাজার ১২টি বেসরকারি এতিমখানার ১ লাখ ৬ হাজার এতিম শিশুকে ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট দেওয়া হচ্ছে। দরিদ্র এতিম শিশুদের মানবসম্পদে পরিণত করাই ক্যাপিটেশন গ্র্যান্টের প্রধান উদ্দেশ্য।

সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধিত বেসরকারি এতিমখানায় ২০১৯-২০২০ অর্থবছর থেকে এতিম শিশুদের মাথাপিছু মাসিক ২ হাজার টাকা করে সরকারি অনুদান দেওয়া হয়।  এর মধ্যে খাদ্য বাবদ ১৬০০ টাকা, পোশাক বাবদ ২০০ টাকা এবং চিকিসা ও অন্যান্য বাবদ ২০০ টাকা। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) ৪ হাজার ১২ প্রতিষ্ঠানের ১ লাখ ৬ হাজার জনকে ২৫৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা দেওয়া হয়।

বেদে সম্প্রদায়কে আর্থিক সহায়তা বেদেরা যাযাবর জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। তারা মূলত নৌকায় বসবাস করেন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ক্ষুদ্র অংশ বেদে সম্প্রদায়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ প্রায় ৭৫ হাজার জন। বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন তথা এ জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে বর্তমান সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছর থেকে এ কর্মসূচির ভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তির নগদ সহায়তা জিটুপি পদ্ধতিতে উপকারভোগীর মোবাইল হিসাবে পাঠানো হচ্ছে।

৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল বেদেদের  মাসিক ৫০০ টাকা হারে বিশেষ বয়স্কভাতা দেওয়া হচ্ছে। স্কুলগামী বেদে শিক্ষার্থীদের মাসিক হারে প্রাথমিক স্তরে ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৮০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ১ হাজার টাকা এবং উচ্চতর স্তরে ১ হাজার ২০০ টাকা দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ৭৫ হাজার ব্যক্তি প্রশিক্ষণ ও বিশেষ ভাতা পাচ্ছেন এবং শিশুরা উপবৃত্তি পাচ্ছে। হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ৮৫ হাজার জনকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে।

রোগীদের সহায়তা প্রতিবছর দেশে প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোক ও থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অর্থের অভাবে এসব রোগে আক্রান্তরা যেমন ধুঁকে ধুঁকে মারা যান, তেমনই তাদের পরিবার চিকিৎসার ব্যয় বহন করে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে এসব অসহায় রোগীদের এককালীন ৫০ হাজার  টাকা আর্থিক সহায়তা করছে। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) এ পর্যন্ত মোট ৪০ হাজার জনকে ২০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালে সমাজসেবা কার্যক্রম রোগগ্রস্ত মানুষদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে অসহায় রোগীদের বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে রোগীর মানসিক শক্তি বৃদ্ধি, চিকিৎসার ব্যয় বহন, চিকিৎসককে রোগীর রোগ ও রোগের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য প্রদান এবং চিকিৎসা শেষে তার পুনর্বাসনের জন্য সহায়তা দেওয়া হয়।

বর্তমানে ঢাকাসহ ৬৪টি জেলায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ১০৮টি ইউনিট এবং উপজেলা পর্যায়ে ৪২০টি উপজেলা হেল্থ কমপ্লেক্সে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। 

৩০ শতাংশ রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা  সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ৩৭টি হাসপাতালে ৩০ শতাংশ গরীব রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।

চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি চা শিল্প জাতীয় অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশের চা উৎপাদনের পরিমাণ বছরে প্রায় ৯৬.০৭ মিলিয়ন কেজি। চা রপ্তানি করা হয় ২৫টি দেশে। কিন্তু, চা শ্রমিকরা সকল নাগরিক সুবিধা ভোগের অধিকার সমভাবে প্রাপ্য হলেও তারা পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার। চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬০ হাজার জনকে ৩০ কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো—আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান। আপৎকালীন সময়ে চা-শ্রমিকদের অর্থ সহায়তা প্রদান।