রাইজিংবিডি স্পেশাল

নিরেট অবসরে যাবেন রাষ্ট্রপতি, থাকবেন নিকুঞ্জে করবেন লেখালেখি

# রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি ‘হামিদ ভাই’ # সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন ‘এলাকার মাছের দাওয়াত’ # শুধুমাত্র একজন মানুষ হাওরের পশ্চাৎপদ অঞ্চলকে যুক্ত করেছেন উন্নয়নের মূল ধারায়

দেশপ্রেম থাকলে, মাটি এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকলে শুধুমাত্র একজন মানুষই যে দৃশ্যপট বদলে দিতে পারেন, তার জীবন্ত উদাহরণ বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। পর্যাপ্ত স্থলভূমি ছিল না বলে একটা সময় কেউ মারা গেলে পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো, এখন সেখানে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। একক প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতায় হাওরের পশ্চাৎপদ অঞ্চলকে উন্নয়নের মূল ধারার সঙ্গে যুক্ত করেছেন তিনি।

হাওর এলাকার মানুষ বলেই এই উদাহরণটা হয়তো শুরুতে এলো। কিন্তু শুধু হাওরের নন, তিনি এখনও গোটা বাংলাদেশের অভিভাবক। দেশের অন্যতম সফল এবং জননন্দিত রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ।

রোববার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে সিনিয়র সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির মতবিনিময়

রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি আর ৪২ দিন দায়িত্ব পালন করবেন। বিদায় নেওয়ার আগে রোববার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে সিনিয়র সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। সম্পাদক আবেদ খান তার স্মৃতিচারণে বলেন, একবার আমাদের রাষ্ট্রপতিকে ‘প্রেসিডেন্ট সাহেব’ বলে সম্বোধন করায় তিনি বলেছিলেন— প্রেসিডেন্ট হলেও আমি আপনাদের ‘হামিদ ভাই’। 

অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণের ক্ষেত্রে অধিকাংশই রাষ্ট্রপতিকে ‘হামিদ ভাই’ বলেও সম্বোধন করেছেন। এই নজির পৃথিবীতে খুব বেশি আছে কি না সন্দেহ! রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি এতটা সাদামাটা।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদ অনন্য এক রেকর্ডের অধিকারী। দেশের ইতিহাসে দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তার পূর্বসূরি আর কারও এই সৌভাগ্য হয়নি। কোনও বিতর্ক ছাড়াই তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যক্তি আবদুল হামিদ যতটা নন্দিত, ততটাই জনপ্রিয় তিনি রাষ্ট্রপতি, রাজনীতিক, মানুষ হিসেবে। এতটা নিরেট জনপ্রিয়তার উদাহরণ বিশ্বেও খুব বিরল। 

এরকম ইর্ষনীয় সাফল্যের গোপন সূত্র সর্ম্পকেও মজার আলাপে বলছিলেন তিনি। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমি লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিলাম না। থার্ড ডিভিশনে মেট্রিক পাস করেছিলাম। ইন্টার, ডিগ্রি এর চেয়ে কিছুটা ভালো। প্রথম ক্লাস পাইনি। কিন্তু সারাজীবন স্বচ্ছ রাজনীতি করেছি, কাজে-চিন্তায় নিজেকে সবসময় সৎ রেখেছি। নিজের জন্য কখনো কিছু চাইনি, মানুষের জন্য চেয়েছি, কাজ করার চেষ্টা করেছি। যখন যে দায়িত্ব কাঁধে এসেছে নিষ্ঠার সাথে পালন করেছি। এজন্য আপনাদের অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়েছি।’

জানালেন, বাকি জীবনটাও তিনি এভাবেই কাটাতে চান। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নিরেট অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে যতই লোভনীয় কিছু হোক না কেন সেখানে তার কোনও অবস্থাতেই যাওয়া ঠিক নয়। এটা করলে তা দেশের মানুষকে অপমান করা হবে, বেইজ্জতি করা হবে। দেশের মানুষের সম্মান ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনও কাজে অবসরের পর আমি যাবো না।’

বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে রাইজিংবিডি ডটকম-এর প্রধান প্রতিবেদক হাসান মাহামুদ

অবসরের পর রাষ্ট্রপতি তাঁর নিকুঞ্জের বাড়িতে থাকবেন বলেও জানান। বলেন, ‘আমাদের দেশে এরকমও হয়েছে, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে কেউ মন্ত্রী হয়েছেন। আবার দেখা গেল কেউ এমপি নির্বাচনে নমিনেশন না পেয়ে উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে দাঁড়ায় গেলো। হায়াত থাকলে হয়ত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদেও দাঁড়িয়ে যেত। এটা হওয়া উচিত নয়। আমি যে অবস্থাতে চলি না কেন, এদেশের মানুষের সম্মান ক্ষুণ্ন হোক এমন কোনও কাজে যাব না।’

সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। অবসরে তিনি বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড লেখারও ঘোষণা দেন। এসময়ে তাঁর বইয়ের কিছু উদাহরণও বক্তব্যে তুলে ধরেন তিনি। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে লেখা একটি অধ্যায়ের প্রসঙ্গ টানেন। বইয়ের ওই অংশটি ‘পুরোপুরি ঠিক নয়’ বলে তাঁর স্ত্রী অভিযোগ করেছেন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ‘বইয়ে আমার বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে যা লিখেছি তা সব ঠিক নয় বলে দাবি করেছে। আর বলেছেন, আমি কিছু কিছু কথা লিখিনি। সমস্যা হচ্ছে যে, কমপ্লিটলি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হলে এক রকম হয়। দেড়-দুই বছর থেকে জানাশুনা থাকলে যা হয়। সেখানে তো সমস্যা একটু থাকবে। কারণ তার দৃষ্টিভঙ্গি আমার দৃষ্টিভঙ্গি, কথা ও লেখায় একটু পার্থক্য তো থাকবেই। তবে বলতে পারি, আমি যা লিখেছি ঠিক। তার হয়ত পছন্দ না হতে পারে। সুতরাং সঠিক করে আর লেখার কিছু নেই। আমি যা লিখেছি সত্য লিখেছি। তার কাছে হয়ত আমার এই কথাগুলো ভালো লাগেনি।’

আগামী ২৩ এপ্রিল আবদুল হামিদের রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পূর্ণ হবে। এজন্য রাষ্ট্রপতি গণমাধ্যমকর্মীদের সম্মানে বঙ্গভবনে নৈশভোজের আয়োজন করেন। এদিন রাষ্ট্রপতির বিশেষ আমন্ত্রণে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক এবং সিনিয়র সাংবাদিকরা রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন বঙ্গভবনে যান। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বঙ্গভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে এটাই শেষ নৈশভোজ।

রাষ্ট্রপতি দরবার হলের অনুষ্ঠানস্থলে আসেন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। রাষ্ট্রপতি আসার পর পুরো দরবার হল যেন প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে। এসময় সাংবাদিক-বান্ধব রাষ্ট্রপতি ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। তিনি তাঁর সেই চিরাচরিত স্বভাব কথার জাদুতে দরবার হলকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। ছবিও তোলেন। প্রটোকল ডিঙিয়েই রাষ্ট্রপতি জুনিয়র-সিনিয়র সব সাংবাদিকের কাছে গিয়ে হাত মেলান।

সাংবাদিকদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ের এই আয়োজনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন তিনি। নিজের রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে আজ অবধি সাংবাদিকদের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন খোলামেলা। ব্যক্তিজীবনের শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে রাজনীতির শৈশব থেকে যৌবনে পদার্পণ নিয়ে নিজের লেখা প্রথম বইয়ে সবকিছু উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রপতি। দশ বছর মেয়াদ পূর্তির আর মাত্র ৪২ দিন বাকি থাকার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, অবসর কাটানোর ইচ্ছা রয়েছে লেখালেখি করে।

বক্তব্যের শুরুতেই রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ‘রাজনীতি করার সময় আমি বক্তৃতা করেছি ঠিকই কিন্তু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর আমার তো লিখিত বক্তৃতা দিতে হয়। রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ১০ বছর হয়ে যাচ্ছে। ১০ বছর হতে আর মাত্র ৪২ দিন বাকি। ৪২ দিন পর আমার ১০ বছর পূর্ণ হবে। এর আগে প্রথমে আমি হই ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সাহেব মারা যাওয়ার পর আমি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে ছিলাম ৪০ দিন।’

তিনি বলেন, ‘আমি ক্লাস নাইন থেকে রাজনীতি করি। ১৯৬১ সালে নাইন-টেনে থাকাকালে ছাত্রলীগ করেছি। আমি মেট্রিক পাস করার পরই নেতা হয়ে গেছি। রাজনীতির শুরু থেকে এ পর্যন্ত সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে আমার একটা পুরাতন সম্পর্ক। রাজনীতিতে আমি যতটুকু সুনাম অর্জন করেছি এতে সাংবাদিক ভাইদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। পার্লামেন্টে থাকা অবস্থায় আপনাদের সঙ্গে যেভাবে কথাবার্তা বলতে পারতাম, এ ১০ বছরে ওইভাবে হয়নি। তবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর আমার আর এ সমস্যা থাকবে না।’

হাওরের পশ্চাৎপদ অঞ্চলকে উন্নয়নের মূল ধারার সঙ্গে যুক্ত করেছেন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রত্যেক রাজনীতিবিদদের নিজ নিজ এলাকার জন্য কাজ করা উচিত।

বঙ্গভবনে সিনিয়র সাংবাদিক ও সম্পাদকদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ফটোসেশন

সব রাজনীতিককে ব্যক্তি-স্বার্থের ঊর্ধ্বে সমাজ কিংবা এলাকার জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘হাওর এলাকার কিছুটা পরিবর্তন আনতে পেরেছি। কোনও সরকারের আমলেই ব্যক্তির জন্য কিছু চাইনি। প্রতিটি রাজনীতিবিদ যদি এরকম মন-মানসিকতা পোষণ করেন, তাহলে অবশ্যই এলাকার উন্নয়ন হবে।’

সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সারাজীবন সততার সাথে রাজনীতি করেছি, ৬৪ বছরের জীবনে সাংবাদিকদের কাছ থেকে আমার জন্য নেগেটিভ কিছু পাইনি, অনেক সহযোগিতা পেয়েছি; সংবাদকর্মীদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

আলাপকালে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ উপস্থিত সাংবাদিকদের মিঠামইনে মাছের দাওয়াত দিয়েছেন। এসময় তিনি জানান, বঙ্গভবনে সবার জন্য মাছ রান্না করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরিচিতজনের পরামর্শে তা আর করা হয়নি।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন আবদুল হামিদ। জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংঘাতময় জটিল একটি রাজনৈতিক পরিবেশে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি। আগামী ২৩ এপ্রিল আবদুল হামিদের রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পূর্ণ হবে। আগামী ২৪ এপ্রিল বেলা ১১টায় নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিনের শপথ নেওয়ার কথা রয়েছে।