শচীন বর্মন : বয়স ৩৩ ছুঁই ছুঁই। মুখের গঠনটাই এমন, দেখলে মনে হতে পারে সর্বদাই ক্লান্ত। বাস্তবে যে তিনি অফুরন্ত জীবনীশক্তির অধিকারী। বিশ্বকাপ শুরুর আগে অধিকাংশই হয়ত তাকে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার তালিকায় রাখেননি। অথচ টুর্নামেন্টের শেষ দিকে মেসি, রোনালদো, নেইমারকে আড়াল করে একটাই নাম জ্বল জ্বল করছে। সেটা ‘লুকা মডরিচ’। তার বয়সে অনেক ফুটবলারই অবসরে চলে যায়। অথচ এই বয়সেও ক্লান্তি শব্দটাকে অবসরে পাঠিয়েছেন তিনি। গ্রুপপর্ব থেকে সেমিফাইনাল পর্যন্ত ছয় ম্যাচে মডরিচ মাঠে ছিলেন ৬০৪ মিনিট। দৌড়েছেন প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে বল পায়ে ২৫ কিলোমিটার। মডরিচের ফুসফুস দুটি, নাকি চারটি? এ নিয়ে সন্দিহান অনেকেই! ৯৮-এ ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান, ২০০৬ সালে আর্জেন্টিনার রিকেলমে, ২০১০ সালে উরুগুয়ের ফোরলানের সঙ্গে কেউ কেউ মডরিচের তুলনা করছেন। তবে এই ক্রোয়াট অধিনায়ক কারও সঙ্গে নিজের তুলনায় যেতে চান না। একটা কথাই বলে দিয়েছেন, ‘আর কেউ না, আমি মডরিচ।’ বিশ্বকাপে শুধুই দৌড়ঝাপ দিয়েই শেষ নয়, মাঝমাঠের ইঞ্জিন হয়ে ক্রোয়েশিয়াকে প্রথমবারের মতো তুলেছেন ফাইনালে। রিয়াল মাদ্রিদের এই তারকা ছয় ম্যাচের তিনটিতেই হয়েছেন ম্যাচসেরা। যেটা এই বিশ্বকাপে আর কেউই হতে পারেনি। বিশ্বকাপের সোনার বল তো ক্রোয়েশিয়ার সোনার ছেলেরই প্রাপ্য। মাঝমাঠের এই নিরব জাদুকর সেমিফাইনাল পর্যন্ত বুড়ো হাড়ের যে ভেলকি দেখিয়েছেন, আক্ষরিক অর্থেই তা অবিশ্বাস্য। বিশ্বকাপ জিতলে তো কথাই নেই, হারলেও টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কারে এগিয়ে থাকবেন মডরিচই।
তারই তো সেরা হওয়ার কথা। শুধু ফুটবল মঞ্চে নয়, জীবনের শুরুটাই যে তার হয়েছে লড়াই করে। তার বয়স যখন ছয়, তখনই ক্রোয়েশিয়া স্বাধীনতা লাভের দ্বারপ্রান্তে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই সময়ে ভয় কখনো কাবু করতে পারেনি ছোট্ট মডিরিচকে। শরনার্থী শিবিরের মতো হোটেলের ছোট্ট একটি রুমে গাদাগাদী করে থাকত মডরিচের পরিবার। দূর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসত গ্রেনেডের আওয়াজ, কখনো বাতাসে মিসে থাকত বারুদের গন্ধ। ইচ্ছা করলেই ঘরের জানালা-দরজা খুলে বাইরে বের হতে পারতেন না ছোট্ট মডরিচ। এর মধ্যেও তার সঙ্গী ছিল একটাই ‘ফুটবল’। যখনই সময় পেতেন বল নিয়ে নাড়াচাড়া করা শুরু করে দিতেন। ঘুমের মধ্যেই নাকি বলে লাথি মারতেন! মডরিচের জন্ম ক্রোয়েশিয়ার জাদার শহরের পাহাড়ের ধারে মডরিচি নামে এক গ্রামে। ১৯৮৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। দাদা লুকা সিনিয়র আর গ্রামের নামের সঙ্গে মিল রেখেই তার নাম রাখা হয় লুকা মডরিচ। ছোট্ট থেকেই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয়েছে তার। মানুষ হয়েছেন দাদার কাছে। বাবা মারা যান যুগোস্লোভিয়ার বিপক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে গিয়ে। পিতাকে নৃশংসভাবে খুন হতে দেখেছেন ছয় বছরের মডরিচ। এরপর তার পরিবারর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সেটা পারেনি। পরে তারা আশ্রয় নেয় জাদারের কোলোভারে নামক একটি হোটেলে। ওই হোটেলেই মডরিচের ফুটবল কৌশল দেখে মগ্ধ হতেন অন্যরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই এনজেড জাদারের যুব একাডেমির পরিচালক তাকে দেখেই মুগ্ধ হন। নিয়ে নেন নিজের ক্লাবে। বাবা বেঁচে থাকতে পোশাক শ্রমীকের কাজ করতেন। আজ বেঁচে থাকলে ছেলের কীর্তিতে নিজেও গর্ববোধ করতেন।
ওপর থেকে নিশ্চয় ছেলের কীর্তি দেখছেন! আর ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে বিশ্বকাপ এনে দিতে পারলেই মডরিচই হবেন হয়ত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। বাবার উদ্দেশে তখন বলতে পারবেন, ‘বাবা তুমি এই দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছ। আর আমি স্বাধীন দেশকে সবচেয়ে বড় উপহার, সবচেয়ে বড় সম্মান এনে দিয়েছি।’ রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জুলাই ২০১৮/শচীন বর্মন/পরাগ