ফিরে দেখা ২০১৯

বছরের আলোচিত মঞ্চ নাটক

চলতি বছর ঢাকার মঞ্চে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু নতুন নাটক। এর মধ্যে গল্প, অভিনয় শৈলী এবং সেট ডিজাইনের দিক থেকে কিছু নাটক ছিল আলোচনার শীর্ষে। চলতি বছরের আলোচিত ১০ নাটক নিয়ে সাজানো হয়েছে এই প্রতিবেদন।

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে অনন্য নাম সৈয়দ জামিল আহমেদ। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ‘রিজওয়ান’ মঞ্চে এনে ঢাকার নাট্যাঙ্গনে রীতিমতো ঝড় তুলেছিলেন। চলতি বছরও নতুন নাটক মঞ্চে এসেছে জামিল আহমেদের নির্দেশনায়। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ মঞ্চে এনেছে যোজনাভিত্তিক নাট্য সংগঠন ‘স্পর্ধা’। গত ১৪ মার্চ সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। আর ৪৮তম স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে শুধু এই নাটকটি মঞ্চায়নের মাধ্যমে ‘মুক্তিযুদ্ধ নাট্য উৎসব’ শিরোনামে সপ্তাহব্যাপী নাট্যযজ্ঞের আয়োজন করে দলটি। এর মধ্য দিয়ে একাত্তরের স্বাধীনতায় শহীদদের প্রতি, শেখ মুজিবের প্রতি, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এছাড়া ১৭ মার্চ শেখ মুজিবের ৯৯তম জন্মবার্ষিকীতে প্রদর্শনীটি জাতির জনককে  উৎসর্গ করে স্পর্ধা। তবে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমার ভুল ব্যাখ্যার অভিযোগ ওঠে এই নাটকের নির্দেশকের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে অনেক নাট্যজন প্রতিবাদও জানান।

স্তালিন

ঢাকার মঞ্চে কামালউদ্দিন নীলু মানেই ভিন্ন চমক। এর আগে ‘অ্যাম্পিউটেশন’, ‘দ্য কমিউনিকেটর’, ‘সেনাপতি’, ‘রিকোয়েস্ট কনসার্ট’ নাটকগুলোর মাধ্যমে দর্শকের মধ্যে সাড়া ফেলেন তিনি। বিদেশে বসবাস করলেও দু-এক বছর পরপর দেশে আসেন, আর মঞ্চে উপহার দেন নতুন নাটক। এবছর এই নির্দেশক মঞ্চে নিয়ে আসেন ‘স্তালিন’। সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা যোসেফ স্তালিনের জীবনচিত্রের আলোকে রচিত নাটকটির বাংলা ভাষান্তর করেছেন রায়হান আখতার। ১২ জুন সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালা মূল হলে নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা প্রাঙ্গণে ঢুকেই চমকে গিয়েছিল সব দর্শক। চারদিকে লাল আর লাল। এই লালের মধ্যে হাতুড়ি ও কাস্তের পাশাপাশি পাঁচ কোণবিশিষ্ট তারকা। জাতীয় নাট্যশালার করিডর থেকে শুরু করে পুরো মিলনায়তন নাটক পরিবেশনের জন্য ব্যবহার করেন নির্দেশক। মিলনায়তনের বাইরেও সেট সাজানো হয়। সেখানেও ছিল লালের উপস্থিতি। চারদিকে লাল কাপড়। মূলত এই নাটকে কামালউদ্দিন নীলু স্তালিনকে একজন গণনায়ক ও কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসেবে দেখিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি এমন এক বিশাল ছায়া, যা তার মৃত্যুর পরেও দুনিয়াকে আবিষ্ট করতে পারে। এই নাটকে নিবন্ধিত ঘটনা, তার রূপ-গন্ধ-মেজাজে স্পষ্টই সোভিয়েত ইতিহাস গেঁথে আছে। এটি ক্ষমতাবৃত্তের এক আশ্চর্য নমুনা যেখানে একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক আত্মবিস্তারের অনিবার্যতায় তার চারপাশে চাটুকারের দল জড়ো করেন। এই চাটুকারেরাই পরগাছার মতো তার স্বপ্নকে শেষ করে দেয়। নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার পর নাটকপাড়ায় শোরগোল পড়ে যায়। অনেকে নাটকটির প্রশংসা করলেও কেউ কেউ ‘ইতিহাস বিকৃতির’ অভিযোগ তুলে শিল্পকলার সামনে প্রদর্শনী বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করেন।

কালো জলের কাব্য

গত বছর দলের ৫০ বছর পূর্তি করে নাগরিক। সেই সঙ্গে দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়নের ৪৫ বছর উদযাপন করে। এরই অংশ হিসেবে এবছর দলটি আয়োজন করে ‘নতুনের উৎসব ২০১৯’। লক্ষ্য ছিল মঞ্চে মানসম্পন্ন নতুন নাটক নিয়ে আসা এবং প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ নির্দেশকদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া। উৎসবের উদ্বোধনী দিন মঞ্চস্থ হয় ‘কালো জলের কাব্য’। এটি নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের ৪৭তম প্রযোজনা। এটি রচনা ও নির্দেশনায় ছিলেন পান্থ শাহরিয়ার। নাটকটি উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর দেশের প্রেক্ষাপটে নিজস্ব আঙ্গিকে রূপায়ণ করা হয়েছে। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর। এই নাটকের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৮ বছর পর তাকে আবার মঞ্চে দেখা যায়। এ নাটকে অপি করিমের মতো উজ্জ্বল তারকাও ছিলেন।

একা এক নারী

নাট্যাঙ্গনের সুপরিচিত মুখ তনিমা হামিদ। তবে এবছর প্রথমবারের মতো তার অভিনীত একক নাটক মঞ্চস্থ হয়। নাট্যচক্রের ধারাবাহিক কার্যক্রমের আওতায় গত ২৩ মার্চ মঞ্চে আসে নাটক ‘একা এক নারী’। ইতালির নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক, নাট্যকার ও অভিনেতা দারিও ফো এবং ফ্রাংকা রামে রচিত ‘এ উমেন এলোন’ নাটকের অনুবাদ ‘একা এক নারী’। এটি এই নাট্যদলের ৫৪তম প্রযোজনা। নাটকটি অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম এবং নির্দেশনা দিয়েছেন দেবপ্রসাদ দেবনাথ।

খোয়াবনামা

গতানুগতিক পটভূমির বাইরে কাজ করার জন্য সুপ্রশংসিত নাট্যদল প্রাচ্যনাট। এবছর নতুন প্রযোজনা হিসেবে দলটি মঞ্চে নিয়ে আসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসের নাট্যরূপ। গত ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘নতুন নাটকের উৎসব’-এর পঞ্চম দিন ‘খোয়াবনামা’ নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়। দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখার ৪৫ বছর পূর্তিতে সাত তরুণ নাট্যশিল্পীকে নাট্য নির্দেশনার জন্য প্রণোদনা দেয় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। প্রাচ্যনাট থেকে এই প্রণোদনা পান কাজী তৌফিকুল ইসলাম। ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাস মূলত ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কিছু পূর্ব ও পরবর্তী সময়ের ঘটনার পটভূমিতে রচিত। এটি যেমন কালজয়ী উপন্যাস, তেমনি নাটকটির চরিত্ররাও নিজ নিজ গুণে মঞ্চে বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। এরকম একটা উপন্যাসকে যখন নাট্যরূপ দেওয়া হয়, তখন অভিনেতাদের মুন্সিয়ানা দেখানোর চ্যালেঞ্জটাই সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায়। এই নাটকে কাহিনির পটভূমি দিয়ে আলাদা কোনো বার্তা বহনের প্রয়াস ছিল না, সেট লাইট-কস্টিউমেরও বাহুল্যও ছিল না। তবে অভিনেতাদের একেকজনের তমিজের বাপ, তমিজ, কুলসুম, শরাফত মণ্ডল ইত্যাদি চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন।

লেট মি আউট

ঢাকার মঞ্চে এবছর আত্মপ্রকাশ করেছে বেশ কিছু নতুন নাটকের দল। গত ১৯ এপ্রিল ঢাকার নাট্যাঙ্গনে যুক্ত হয় নতুন নাটকের দল ‘তাড়ুয়া’। এদিন রাজধানীর মহিলা সমিতি মিলনায়তনে তাদের প্রথম প্রযোজনা ‘লেট মি আউট’ নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয়। রুনা কাঞ্চনের লেখা নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন এ সময়ের মেধাবী নাট্যনির্দেশক বাকার বকুল। মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা করছেন আসলাম অরণ্য, সংগীত পরিকল্পনা: রবিউল ইসলাম শশী ও ইসমাইল পাটোয়ারী। পোশাক পরিকল্পনা: শাহনাজ জাহান। কোরিওগ্রাফি: ফরহাদ শামীম। ১৯২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলস পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, যাদের রয়েছে স্পেশাল ফোর্স ‘গান স্কোয়াড’। এমন এক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বিরুদ্ধে ক্রিস্টিন কলিন্স নামে এক মায়ের অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে নাটকের গল্প।

রাত ভরে বৃষ্টি

১৯ জুলাই মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় নতুন নাটক ‘রাত ভরে বৃষ্টি’। এ দিন ছিল নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন। বুদ্ধদেব বসুর লেখা উপন্যাস থেকে নাটকটি মঞ্চে নিয়ে এসেছে নাটকের দল আপস্টেজ। আর এই নাটকের মাধ্যমে দেশের নাট্যাঙ্গনে যুক্ত হয় ‘আপস্টেজ’ নামে আরেকটি নাটকের দল। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন সাইফ সুমন। বিয়ে ও সংসার নামক সম্পর্কে আবদ্ধ তিন নর-নারীর মনোদৈহিক টানাপোড়েনের গল্প ‘রাত ভরে বৃষ্টি’। মধ্যবিত্ত সমাজ জীবনে স্বামী-স্ত্রী বা বিবাহিত নারী-পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্কেও নানা জটিলতা থাকে। থাকে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রকাশ। মূলত প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য লেখা এই নাটকটি মঞ্চে এনে বেশ সাহসিকতার পরিচয় দেয় ‘আপস্টেজ। নাটকটিতে অভিনয় করেন প্রশান্ত হালদার, রঞ্জন দে সাথী ও কাজী রোকসানা রুমা।

এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট

এবছর ঢাকার নাট্যাঙ্গনে যুক্ত নতুন নাটকের দলগুলোর মধ্যে এমটি স্পেস অন্যতম। একঝাঁক তরুণ নাট্যপ্রাণ মঞ্চশিল্পী একত্রে গড়ে তুলেছেন নাটকের দলটি। গত ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মঞ্চে দলটির প্রথম প্রযোজনা ‘এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয়। সাইমন জাকারিয়া রচিত নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন নূর জামান রাজা। নাটকের মঞ্চসজ্জা, আলোক ও পোশাক পরিকল্পনাসহ আবহ সংগীত পরিকল্পনাও করেছেন তিনি। উইলিয়াম শেকসপিয়রের ‘দ্য ট্রাজেডি অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’র আখ্যানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে লেখা হয়েছে ‘এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকটি। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন কবি। যিনি পূর্ণিমা রাতে কবরস্থানে এসে ফুলের গন্ধে মাতাল হন আর নিষ্ঠা প্রেমের গান করেন। তার এই গান শুনে সেই স্থানে এসে হাজির হয় রোমিও আর জুলিয়েট। এভাবেই চলতে থাকে নাটকের ঘটনা আর এই ঘটনাচক্রে এক পর্যায়ে উপস্থিত হয় ফাদার ফ্রায়ার এবং সর্বশেষে শেকসপিয়র।

হিমুর কল্পিত ডায়েরি

চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন রানা প্লাজা ধসের স্বেচ্ছাসেবক নওশাদ হাসান হিমু। প্রয়াত হিমু স্মরণে তারুণ্যদীপ্ত থিয়েটার সংগঠন বাতিঘর মঞ্চে আনে নতুন নাটক ‘হিমুর কল্পিত ডায়েরি’। গত ২১ জুলাই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার স্টুডিও থিয়েটার হলে নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসে এক হাজারেরও বেশি পোশাক শ্রমিক নিহত হয়। ১৫ দিন ধরে হিমুর মতো যারা স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেছে, তাদের মানসিক সুস্থতার কোনো দায়ভার নেয়নি রাষ্ট্র। সেই কথা আবারো স্মরণ করিয়ে দেয় এই নাটক। ব্যতিক্রমী এই নাটক রচনা ও নির্দেশনা দিচ্ছেন বাতিঘরের দলপ্রধান মুক্তনীল। নাটকটিতে একক অভিনয় করেন সাদ্দাম রহমান।

আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে

নাট্যদল থিয়েটার ফ্যাক্টরি গত ২৪ জুলাই মঞ্চে নিয়ে আসে তাদের প্রথম প্রযোজনা ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার হলে নতুন নাট্য সংগঠন থিয়েটার ফ্যাক্টরির প্রথম এ প্রযোজনার উদ্বোধনী মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয়। আদিকবি কালিদাস অবলম্বন করে নাটকটি রচনা করেছেন মোহন রাকেশ। অনুবাদ করেছেন নাট্য গবেষক অংশুমান ভৌমিক। নির্দেশনা দিয়েছেন অলোক বসু। কালিদাসকে ঘিরেই এ নাটক। তবে এটি কালিদাসের জীবনী নয়। এর মূল চরিত্র মল্লিকা। তার সঙ্গে কালিদাসের জীবনের নানা মর্মস্পর্শী ঘটনা নিয়ে গড়ে উঠেছে এ নাটকের কাহিনি। ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছেন সঞ্জিতা শারমীন, শামসুন নাহার বিউটি, রামিজ রাজু, শারমীন মাসরুরা খানম, হাসানুজ্জামান খান, সুমন মন্ডল বানি প্রমুখ।

 

ঢাকা/তারা