ফিরে দেখা ২০১৯

অর্থনীতিতে সুখবর ছিল কেবল প্রবাসী আর মাথাপিছু আয়ে

গত এক দশকে বিশ্বের যে কয়েকটি দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বাংলাদেশের। অর্থনীতির আকারও বাড়ছে ক্রমবর্ধমান হারে। তবে চলতি বছরে দেশের অর্থনীতি খুব বেশি সুখবর দিতে পারেনি।

অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক নিম্নমুখী ছিল। রাজস্ব আয়, রপ্তানি আয় ও আমদানিতে প্রবৃদ্ধি নেই। বছরে মূল্যস্ফীতি ছিল উর্ধ্বমুখী। এই সময়ে সরকারের ঋণ করার প্রবণতা বেড়েছে। কমেছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। তবে সারা বছরই সুবাতাস ছিল প্রবাসী আয়ে। এ ছাড়া, দেশের মাথাপিছু আয় চলতি বছরেও বেড়েছে।  

এ খাতে চলতি বছরে আলোচিত বিষয় ছিল রেমিট্যান্সে প্রণোদনার ঘোষণা এবং ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা প্রদান। নতুন তিনটি ব্যাংক অনুমোদনের বিষয়টিও ছিল আলোচনায়। এ ছাড়া প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে দেশের জাতীয় বাজেটের আকার। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট ঘোষিত হয় চলতি বছ‌র। এতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রাও ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে সর্বাধিক। মাথাপিছু আয়ের সূচকে গত কয়েক বছরের মতো এবারো বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে।

রেমিট্যান্সে সুখবর : গত নভেম্বর শেষে প্রবাসী আয় দাঁড়িয়েছে ৭৭১ কোটি ৪১ লাখ ডলার। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির হার ২২.৬৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের এ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ শতাংশ। এ ছাড়া, নভেম্বর মাসে ১৫৫ কোটি ৫২ লাখ (১.৫৫ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট‌্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা ছিল গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ৩১.৭৫ শতাংশ বেশি। প্রবাসী আয়কে উৎসাহ দিতে সরকার এখন ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে। এরই ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবৃদ্ধিতে।

মাথাপিছু আয় বেড়েছে : দেশের সামগ্রিক আর্থিক অবস্থা ভালো হওয়ায় প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বাংলাদেশে মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৯০৯ ডলার। এটি গত বছরে ছিল ১ হাজার ৭৫১ ডলার। আর এতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিও বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত বছর এ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

রিজার্ভ কমেছে : বছরের মাঝামাঝি থেকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। গত অক্টোবর মাস শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২৪৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। গত ১৪ নভেম্বর এটি কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৬৫ কোটি ডলারে। আর নভেম্বর মাসে মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৭২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে।  বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১১ ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২১৯ কোটি ৮৭ লাখ ডলার, ৬ মাস আগে গত জুনে যা ছিল ৩ হাজার ২৭১ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। ৬ মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ৫১ কোটি ৭৮ লাখ ডলার।

রাজস্ব আয়ে ঘাটতি : সামগ্রিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি প্রায় ২০ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এই চার মাসের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের সামান্য বেশি, অথচ এবার গত অর্থবছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। প্রতিবারই বছরের প্রথম দিকে রাজস্ব আদায় কিছুটা কম হয়। তবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে রাজস্ব আদায় বাড়বে বলে আশা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

কমছে রপ্তানি আয় : টানা ৫ মাস ধরে দেশের রপ্তানি আয় কমছে। এই রপ্তানি খাতই দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ মাস অর্থাৎ নভেম্বর শেষে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ১২.৫৯ শতাংশ। এ সময়ে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৮০৫ কোটি ডলার। অথচ আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার। নভেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে ১০.৭০ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছর রপ্তানি কমেছে ৭.৫৯ শতাংশ।

ডলারের দাম বৃদ্ধি : গত কয়েক মাস ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় করতে হতো ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা, চলতি মাসের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। তবে আমদানি পর্যায়ে করপোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে ৮৬ টাকা পর্যন্ত।

আমদানি ব্যয় বেড়েছে : ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাণিজ্য ঘাটতির ওপর। আগে যে পণ্যের দাম ১০০ টাকা ছিল ওই পণ্য শুধু টাকার মান কমে যাওয়ার কারণে এখন ১০৫ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, জুলাই-অক্টোবর ৪ মাসে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা, এর বিপরীতে রপ্তানি আয় হয়েছে ১২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর মাস পর্যন্ত আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৩.১৭ শতাংশ।

বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে : আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে বাণিজ্যে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৬২ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

মূল্যস্ফীতি বেড়েছে : নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.০৫ শতাংশে। যা আগের মাসে ছিল ৫.৪৭ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৬.৪১ শতাংশে এবং খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৪৭ শতাংশে।

সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে : চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে সঞ্চয়পত্রের বিক্রির পরিমাণ ৩ ভাগের ১ ভাগ হয়ে গেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা, আর চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কমে হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণেই বিক্রি কম বলে মনে করছ্নে সংশ্লিষ্টরা।

নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে খেলাপি ঋণ : গত নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত ৯ মাসে দেশে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার নয় কোটি টাকা।

সরকারের ব্যাংক ঋণ : ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। চলতি অর্থবছরের পুরো সময়ে যে ঋণ নেয়ার কথা ছিল তার প্রায় পুরোটা ৫ মাসেই নিয়ে ফেলেছে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ঋণ বা ধার নেয়ার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ৫ মাস ৯ দিনেই (১ জুলাই থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ৪৭ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা নিয়েছে সরকার।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন রা‌ইজিংবিডিকে বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পায়নের দিক থেকে চলতি বছর ভালো কোনো অগ্রগতি ছিল না। রাজস্ব এবং রপ্তানি আয়েও সুখবর ছিল না এই বছর। এই ধারা থেকে বের হওয়া প্রয়োজন। ঢাকা/হাসান/ইভা