বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অ্যাপসে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা লঙ্ঘনে উদ্বেগ

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ডেস্ক : মোবাইল ব্যাংকিং, রাইড শেয়ারিং ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাপসসহ নানা মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা লঙ্ঘন হচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএ ফাউন্ডেশন)। শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো সংগঠনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষা করছে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং এর ফলে যেকোনো সময় ব্যবহারকারীরা ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। মোবাইল ব্যাংকিং, রাইড শেয়ার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাপস, ওয়েবসাইটসহ নানা মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা লঙ্ঘন হচ্ছে। এখন আমরা আমাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকা ডিভাইসগুলোতে ব্যয় করছি। এখনও খুব কম মানুষই জানে যে, আমাদের ব্যবহৃত ডিভাইস ও অনলাইন সেবা থেকে অসংখ্য ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে এবং তা শেয়ার করা হচ্ছে। এসব তথ্য অনির্দিষ্টভাবে গচ্ছিত করা হতে পারে এবং ভালো মন্দ দু’ভাবেই ব্যবহার করা হতে পারে। সরকারি তথ্যমতে, প্রতি বছর দেশে ৪৪ শতাংশ হারে ইন্টারনেট ডাটার ব্যবহার বাড়ছে। দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহারকারীরা নানা ধরনের অ্যাপ স্মার্টফোনে ইনস্টল করছেন। কিন্তু ব্যবহারকারীরা ভালোভাবে না দেখে ইনস্টলের সময় ফোনের অনেক কিছুর তথ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে প্রবেশাধিকারের অনুমতিদিয়ে দিচ্ছে। যার ফলে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে নিজের অজান্তেই স্মার্টফোনের এসএমএস, স্টোরেজ, ছবি, ভিডিও, কললিস্ট, ক্যালেন্ডার, মাইক্রোফোন, অডিও রেকর্ডসহ সকল ব্যক্তিগত তথ্য চলে যায়। ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা আইনের অনুপস্থিতিতে অনেক কোম্পানি তাদের সেবা ব্যবহারকারী ও ক্রেতাদের ব্যক্তিগত আচরণ পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাচ্ছে এবং ভোক্তাদের এসব তথ্য তারা লাভের জন্য তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেয়ার সুযোগও রয়েছে। ভোক্তাদেরও বোঝা প্রয়োজন যে তাদের তথ্যের সঠিক মূল্য আসলে কতটা এবং কিভাবে এই তথ্য সংগ্রহ, ব্যবহার এবং তা শেয়ার করা হচ্ছে। এছাড়া তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের ভালোভাবে ব্যবস্থাপনার বিষয়েও জানা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রমও প্রয়োজন। বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ (খ) নম্বর অনুচ্ছেদে প্রাইভেসি রাইটস বা ব্যক্তির তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬ (১) ধারা অনুযায়ী, আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়া কারো ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, বিক্রয়, দখল, সরবরাহ বা ব্যবহার করা অপরাধ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণা (অনুচ্ছেদ ১২) নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদ (অনুচ্ছেদ ১৭), জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স (অনুচ্ছেদ ১৪) এবং শিশু অধিকার সনদ (অনুচ্ছেদ ১৬)-এ প্রাইভেসিকে অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের কোনো আইনে নাগরিকের তথ্য সুরক্ষার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনাই নেই। এখন সময় এসেছে তথ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের। এটি এখন অনিবার্য। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হতে পারে ব্যবহারকারীরা। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ইকিউফ্যাক্স, ভেরিজন, দ্য এনএসএ ও উবারের মতো প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক মাত্রায় ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। এরই প্রেক্ষাপটে কিভাবে ব্যক্তিগত তথ্য ভালোভাবে নিরাপদে রাখা যায় তা জানা মানুষের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৬৮ শতাংশ ভোক্তা বলছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো (ব্র্যান্ড) তাদের দেয়া ব্যক্তিগত তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে তারা আস্থা রাখতে পারছেন না। এ অবস্থায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভোক্তাদের তথ্য সংগ্রহ ও তার ব্যবহার সম্পর্কে অধিক স্বচ্ছ হওয়া উচিত। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি পরামর্শ: সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা ব্যক্তি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্রচার ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সর্বাধিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কিভাবে বজায় থাকবে তা নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা লঙ্ঘনের মতো চরম নৈতিক অপরাধকে প্রতিহত করার জন্য আইনি ব্যবস্থা থাকা জরুরি। কেউ ইচ্ছা করলেই যাতে আরেক নাগরিকের অধিকার ক্ষুন্ন করতে না পারে সেজন্য শক্ত আইন থাকা উচিত। আইন ব্যক্তির পক্ষে তার অধিকার সংরক্ষণে দায়িত্ব পালন করে। এর সঙ্গে সঙ্গে আইন মেনে চলার জন্য জনসচেতনতাও প্রয়োজন। শুধু আইন দিয়ে এই অপকর্ম বন্ধ করা যাবে না। মানুষ নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়ে সজাগ হলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের মতো চরম নৈতিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তথ্য সংগ্রহে উদ্দেশ্য শনাক্তের ব্যবস্থা থাকা : তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করার আগে কোন তথ্যটি কেন, কী উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা হচ্ছে তা অবশ্যই শনাক্ত করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তথ্য সংগ্রহে নাগরিকের সম্মতি নেয়া : বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে ব্যক্তিগত তথ্য অবশ্যই ব্যক্তির সম্মতিতে সংগ্রহ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর গোপনীয়তার নীতি বাস্তবায়ন : সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যারা তাদের গ্রাহক/ভোক্তার ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করে, তারা যাতে গোপনীয়তার নীতি মেনে চলে সে বিষয়ে সরকারের স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা থাকা খুব জরুরি। ‘ইন্টারনেট অব থিংসের (আইওটি) মতো প্রযুক্তিগত অগ্রসরতার আগামী প্রজন্মের জ্বালানি হলো আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য এবং আমাদের অভ্যাস ও আগ্রহ। আইওটি বলতে আমাদের বাসাবাড়ি, স্কুল ও কর্মক্ষেত্র- সব জিনিসেই ইন্টারনেট ডিভাইসের সংযোগ থাকাকে বোঝায়। তাই কিভাবে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা করা যায় ভোক্তাদের তা অবশ্যই শিখতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে যে, ভোক্তাদের ব্যক্তিগত তথ্য লেনদেনের পদ্ধতি ও তথ্য সুরক্ষা সম্পর্কে তারা স্বচ্ছ। ভবিষ্যতে সংযুক্ত প্রযুক্তির (আইওটি) মাধ্যমে আমাদের জীবনযাপনের বিকাশ ঘটানোর অসাধারণ সুযোগ মিলবে। কিন্তু আমরা কেবল তখনই একটি অধিক নিরাপদ ও আস্থাশীল ইন্টারনেট ব্যবস্থা তৈরি করতে পারব যদি আমরা প্রত্যেকেই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তথ্য সুরক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই এবং ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষায় পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করি।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ নভেম্বর ২০১৮/ফিরোজ