বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মশা এবং অর্কিডের অন্যরকম প্রেম

নীল রঙের চমৎকার অনন্য অর্কিড ফুল যদি আপনি আশেপাশে না দেখেন, তাহলে এতে মন খারাপের কিছু নেই। কেননা এই অন্যরকম সৌন্দর্যমন্ডিত ফুল সাধারণত আমেরিকার উত্তর পশ্চিমে প্যাসিফিক নর্থ-ওয়েস্ট নামক জায়গাটিতেই দেখা যায়।

দুর্লভ প্রজাতির এই অর্কিড ফুল ও মশাকে ঘিরে নিয়ে এক চমৎকার ও অসাধারণ তথ্য জানিয়েছেন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলোজিস্ট জেফ রিফেল। তিনি বলেন, দুর্লভ প্রজাতির এই ফুল আকারে বেশ ছোট হওয়ায় কারো পক্ষে খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট হলেও মশা খুব সহজেই এই ফুল খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়। মশা আর এই ফুলের মধ্যে এক অন্যরকম ভালোবাসার কাহিনি লক্ষ্য করেছেন তিনি। ‌

আমরা অনেকেই মনে করি যে, মশা শুধুমাত্র একটি পদার্থই গ্রহণ করে আর সেটা হলো- রক্ত! তবে আদতে শুধুমাত্র নারী মশা রক্ত পান করে থাকে তাও শুধুমাত্র ডিম পাড়ার সময়। কেননা তারা এই সময়ে রক্ত থেকে অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণ করে যা তাদের ডিম পাড়তে সহায়তা করে থাকে। এছাড়া অবাক করা বিষয় হলো অন্যান্য সময়ে মশা বিভিন্ন ফুল থেকে উচ্চমাত্রার ক্যালোরি সমৃদ্ধ ফুলের মধু পান করে থাকে। তবে তারা কিন্তু সব ধরনের ফুল থেকেই মধু গ্রহণ করতে যায় না। মশার পছন্দের বিশেষ ধরনের কিছু ফুল আছে, শুধুমাত্র সেগুলো থেকেই তারা মধু আস্বাদন করে থাকে।

আর এই সমস্ত বিষয়গুলো জেফ রিফেলকে শুধু একটি প্রশ্নই করে, সেটি হলো ‘মশা কীভাবে এই ফুলগুলোকে আলাদা করতে পারে?’ এমনকি চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মতো ভয়াবহ জীবাণু বহনকারী মশার মধ্যেও ঠিক একই ধরনের আচরণ দেখা যায়।

এই বিশেষ ধরনের অর্কিড ফুলের সাথে আসলে মশার এক অনন্য সম্পর্ক রয়েছে। নর্থ-ওয়েস্ট অঞ্চলে কেবলমাত্র জুনের শেষের দিক থেকে জুলাইয়ের প্রথম দিক পর্যন্ত এই ফুল ফুটতে দেখা যায়। আর ঠিক একই সময়েই বিভিন্ন জলাশয়ে মশা ডিম পাড়া শুরু করে। আবার কোনো কারণে অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে যদি মশার ডিম পাড়তে কিছুটা দেরি দেখা যায় তবে ঠিক একই ব্যাপার পরিলক্ষিত করা যায় এই অর্কিড ফুলের মধ্যেও। এই ফুলগুলোও তখন কিঞ্চিৎ দেরি করে ফুটে থাকে। রিফেল তার গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন, এই বিশেষ ফুলগুলো মশার মাধ্যমেই বেশি পরাগায়ন ঘটে থাকে।

মশার মাধ্যমে পরাগায়ন বেশি ঘটার কারণ হলো মশা এই ফুলের পরাগায়ন ঘটানোর জন্য একদম সঠিক আকারের। ফুলগুলোর মধ্যে মশার মাথা খুব সহজেই ঢুকে যায় এবং যখন মশা ফুলের মধু গ্রহণ করে তখন তাদের মাথায় ফুলের রেণু লেগে যায়। আর মশার মাধ্যমে এই ফুলের পরাগায়নের দৃশ্যটা আসলেই দেখতে অদ্ভুত রকমের সুন্দর!

রিফেল বলেন, এই সময়ে মাঠের মধ্যে আপনি জোনাকি পোকার মতো কিছু পোকা উড়তে দেখবেন। অবাক করা বিষয় হলো এগুলো মাছি, মৌমাছি বা জোনাকি পোকা নয় বরং এগুলো মশা যাদের মাথায় উজ্জ্বল বর্ণের ফুলের রেণু লেগে থাকে। দৃশ্যটা খুবই চমৎকার! আর যে মশাগুলোর মাথায় এই ধরনের উজ্জ্বল রেণু দেখা যায় না সেগুলোর আকৃতি হয় ছোট অথবা একটু বেশি বড় হয়ে থাকে।

এদিকে রিফেলের কৌতূহল দিন দিন বাড়তেই থাকে, তাকে জানতেই হবে কীভাবে মশা এই বিশেষ অর্কিড ফুলগুলো খুঁজে বের করে থাকে। খুব সতর্কতার সাথে প্রায় ৫৮০টি অর্কিড পর্যবেক্ষণ করার সময় দেখা গেছে, সবগুলোর মধ্যেই মশা এসেছে। তবে কাছাকাছি ধরনের অন্যান্য যে অর্কিড ফুল সেখানে হয়ে থাকে সেগুলোর দিকে মশারা ঘুরেও তাকায় না।

মশা কী এই ফুলগুলোর ঘ্রাণের মাধ্যমেই খুঁজে পায় কি না সেটা জানার জন্য ফুলগুলোর উপরে ব্যাগ দিয়ে এমন ভাবে বেঁধে দেয়া হয়েছিল যাতে করে ভিতরে বাতাস আসা যাওয়া করতে পারে। তখন দেখা গেছে, মশা সেই ব্যাগের উপর দিয়েও ফুলগুলো থেকে মধু গ্রহণের চেষ্টা করছে।

রিফেল ছয়টি ভিন্ন প্রজাতির অর্কিড থেকে সেগুলোর ঘ্রাণ সংগ্রহ করেছেন এবং সেগুলোর উপর বিস্তর গবেষণা করেন। এই ঘ্রাণ গঠিত হওয়ার সবগুলো উপাদান নিয়েই তিনি বেশ কিছুদিন গবেষণা করলেন। ওই গবেষণায় যখন সুনির্দিষ্ট একটি উপাদান যোগ করা হয় অথবা আলাদা করা হয় তখন বেশ চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে!

‘এটি বেশ চাঞ্চল্যকর’ রিফেল বলেন। তিনি আরো বলেন, আমরা যখন গোলাপের ঘ্রাণ শুনি তখন আমরা খুব সহজেই বুঝে যাই সেটা গোলাপের ঘ্রাণ। আর মশা ঠিক একইভাবে এই নর্থ-ওয়েস্ট অর্কিড ফুলের মধ্যে এক ধরনের বিশেষ ঘ্রাণ পায় যার মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে এই ফুলের মধ্যে, গ্রহণ করার জন্য এক বিশেষ ধরনের প্রয়োজনীয় সুগার রয়েছে।

এই গবেষণায় আরো একটি মজার তথ্য দেখা গেছে, এই ফুলের মধ্যে এমন একটি কেমিক্যাল রয়েছে যার মধ্যে এক বিশেষ ধরনের ঘ্রাণ রয়েছে। আর এই ঘ্রাণ মানুষের শরীরের ত্বক থেকেও বের হতে দেখা যায় এবং এই ঘ্রাণের মাধ্যমেই মশা মানুষের রক্ত অনুসন্ধান করতে পারে।

রিফেল এই গবেষণার মাধ্যমে মশা ধরার এমন একটি ফাঁদ তৈরি করতে পেরেছেন, যেখানে এই ঘ্রাণ ব্যবহার করে মশাদের আকৃষ্ট করে ধরে ফেলা যায়। রিফেল এই সম্পর্কে বলেন, মশার জ্বালাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই উপায়টি খুবই চমৎকার!

তবে এই ঘ্রাণযুক্ত কেমিক্যাল এখনো খোলা বাতাসে ব্যবহার করা হয়নি। তাই এখনো নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না যে, আদৌ কি এই ফাঁদ বেশ কার্যকর হবে কি না। কেননা, প্রায় সময় দেখা যায় যে ল্যাব অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে অনেক কিছু কাজ করলেও বাস্তবে অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশে সেগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। তবে রিফেল আশাবাদী, আর তার ধারণা এই গবেষণার ফলে মানুষ চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু এবং ম্যালেরিয়ার মতো ভয়াবহ রোগের সাথে আরো কার্যকরীভাবে লড়াই করতে পারবে। ঢাকা/ফিরোজ