অনুশীলন শেষে ইয়াসির আলী ফিরছিলেন বাসায়। রাস্তায় সাক্ষাৎকার দেবেন কিনা জানতে চাইলে মৃদু হেসে বললেন,‘আজ নতুন অভিজ্ঞতা হবে।’ কথোপকথনের পুরোটা সময়ই ছিল প্রানবন্ত। ফোনের অপরপ্রান্তের উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা টের পাওয়া গেল ভালোভাবেই। ক্রিকেট তার কাছে নিউক্লিয়াসের মতো। ২২ গজ তার সবথেকে পছন্দের জায়গা। সবথেকে ভালোবাসার মানুষ বাবা-মা। তাঁদের অনুপ্রেরণা, সহযোগীতার জোরেই আজ ইয়াসির আলী জাতীয় দলে। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের জন্য চট্টগ্রামের এ ক্রিকেটার ডাক পেয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ইয়াসির ১ মে বেলফাস্টের বিমান ধরবেন। হাতছানি দিচ্ছে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপও। ত্রিদেশীয় সিরিজে ভালো কিছু করলে লাল-সবুজের ঝান্ডা উড়ানোর সুযোগ পাবেন বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে। বড় মঞ্চে ২৩ বছর বয়সি ক্রিকেটারের প্রথম পর্দাপণ। কেমন লাগছে ইয়াসিরের? তার পরিকল্পনা, শক্তির জায়গা, দূর্বলতা সব জেনেছেন রাইজিংবিডির প্রতিবেদক ইয়াসিন হাসান। জাতীয় দলে যে সুযোগ পেয়েছেন শুনেছেন কার থেকে? ইয়াসির আলী: আমাদের প্রিমিয়ার লিগের খেলা চলছিল রেলিগেশনের। আমরা মাঠেই ছিলাম। ড্রেসিং রুমে ফিরে শুনেছি যে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের দলে ডাক পেয়েছি। ওরা জানিয়েছিল, বিশ্বকাপ দলেও থাকতে পারি যদি আয়ারল্যান্ডে ভালো করি। ঠিক ওই মুহূর্তে অনুভূতি কেমন ছিল? প্রথমেই কার কথা মাথায় এসেছিল? ইয়াসির আলী: প্রথম কথা, ওই মুহূর্তের অনুভূতি আমি বলে বোঝাতে পারব না। জাতীয় দলে ডাক পাওয়া মেটার অব জোক না। অনেক কষ্ট করে এই পর্যায়ে এসেছি। সবাই এ দিনটার জন্যই তো অপেক্ষা করে। ওই মুহূর্তে আমার আব্বু-আম্মুর কথাই মনে পড়েছিল সব থেকে বেশি। আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের অনুপ্রেরণা, সাপোর্ট সব উনারাই দিয়েছেন। ড্রেসিং রুমে বসে বারবার চিন্তা করছিলাম আব্বু-আম্মু কি খবরটা জানে নাকি জানে না! যদি বলি ছয় মাস আগেও তো চিন্তা করেননি এতোটা আলোচনা হবে আপনাকে নিয়ে? ইয়াসির আলী: আসলে ওরকম চিন্তা আমি কখনোই করিনি। শেষ ছয় মাস আগেও আমার ফিটনেস কিংবা আট মাসেও কিন্তু আমি ফিট ছিলাম না মাঠে নামার জন্য। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। একটা চিন্তায় মাথায় ঘুরত কিভাবে আমি ট্র্যাকে ব্যাক করবো! বিছানায় শুয়ে ভাবতাম শুধু কবে মাঠে ফিরব। বড় গ্যাপ হয়ে গিয়েছিল। কিভাবে অন্যদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারব সেটাই চিন্তা করছিলাম। ভাবতাম শুয়ে শুয়ে সুযোগ যেখানেই পাই, যেই লেভেলেই পাই সেখানেই যেন ভালো করতে পারি। আর এতো বড় পর্যায়ে যে খেলবো কিংবা ডাক পাবো সেগুলো তো চিন্তাও করতে পারিনি। দূর্ঘটনার কথা বললেন…আপনার জীবনের সবথেকে বড় দূর্ঘটনা ঘটেছিল গত বছর। ওই দুঃসময়টা যদি একটু মনে করতেন, কতোটুকু কষ্ট দেয়? ইয়াসির আলী: আমার যখন দুর্ঘটনা ঘটেছিল তখন আমার হাঁটা-চলা নিষিদ্ধ ছিল। তখন আমাদের হাই পারফরম্যান্স স্কোয়াডের ট্রেনিং ছিল। কিন্তু আমি বাসায় শুয়ে-বসে কাটাচ্ছি দূর্ঘটনার জন্য। যাই হোক নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম যে, আল্লাহ হয়তো এবারের ট্রেনিং আমার কপালে রাখেনি। আব্বু আমাকে মানসিকভাবে অনেক সাপোর্ট করেছে। অনেক সাহস দিয়েছিল। বলেছিল, ‘‘রাব্বি হয়তো এখন এখানে নাই। দেখা যাবে পরের বছর ওয়ার্ল্ডকাপে খেলতে পারিস।’’ ওই জিনিসটা আমার খুব মনে ধরেছিল। বাবা এতোটা স্বপ্ন আমাকে নিয়ে দেখছে! তখন থেকেই পরিকল্পনা ছিল যে যখন মাঠে ফিরব। মন দিয়ে খেলবো। অনেক পরিশ্রম করবো। নিজের টার্গেট অ্যাচিভ করবো। বাবা-মা ওই সময়টায় ছিল সবথেকে বড় অনুপ্রেরণাকারী। বাবা বারবার বলতো,‘‘রাব্বী আল্লাহ একটা দরজা হয়তো বন্ধ করেছে। দেখবা, আরও নয়টা দরজা তোমার জন্য ওপেন করে দেবেন যদি তুমি তোমার কাজ ঠিক মতো করো।’’ বলতে পারবেন কোন ইনিংসটি আপনার পথ পরিবর্তন করেছে? ইয়াসির আলী: অনেকগুলো ইনিংসই আমার সেরা। কোনোটাই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে আমার একটা ইনিংস আছে চট্টগ্রামে (৪৮ বলে ৭৮)…ওটাই আমার সেরা ইনিংস বলবো। তবে বিপিএলে বেশ কয়েকটি ভালো ইনিংস ছিল। সেগুলো টার্নিং ইনিংস। আপনি আয়ারল্যান্ড সিরিজের জন্য দলে সুযোগ পেয়েছেন। যদি বিশ্বকাপ দলেই থাকতেন তাহলে কি অবাক হতেন? ইয়াসির আলী: নাহ আমি আসলে অবাক হতাম না। যেভাবে পারফর্ম করে যাচ্ছি সেটার মূল্যায়ন অবশ্যই পাবো সেই বিশ্বাস ছিল। বিশ্বকাপে হয়তো সরাসরি সুযোগ আসেনি। প্রথম একটি ধাপের জন্য আমাকে নেওয়া হচ্ছে। প্রথম ধাপে পাশ করলে অবশ্যই আমাকে নির্বাচকরা বিবেচনায় আনবেন। আয়ারল্যান্ড সিরিজ আপনার জন্য বড় পরীক্ষার জায়গা? বাংলাদেশ যদি ফাইনাল খেলে তাহলে ম্যাচ পাবেন পাঁচটির মতো। এ পাঁচ ম্যাচে আপনার প্রত্যাশিত রান কতো হতে পারে? ইয়াসির আলী: আসলে এভাবে আমি কখনোই চিন্তা করছি না। চিন্তা একটাই আমার, দলের পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার। দল যা ডিমান্ড করে সেটা পূরণ করাই আমার একমাত্র লক্ষ্য থাকবে। আমি এতোদিন যেভাবে খেলে আসছি সেভাবেই খেলে যাবো। আপনার ব্যাটিংয়ে সবথেকে শক্তির জায়গা? ইয়াসির আলী: আমি চার-ছক্কা মারতে পারি। খারাপ বল পেলে কখনো ছাড় দেই না। ভালো বল বানিয়ে মারতে পারি। শুধু এটাই বলবো না, স্ট্রাইক রোটেট করতে পারি ভালো। বলা হচ্ছে সাব্বির, মোসাদ্দেক ও ইয়াসির একই মানের খেলোয়াড়? বাকি দুজনের থেকে আপনি নিজেকে কোন জায়গায় এগিয়ে রাখবেন? ইয়াসির আলী: আসলে কাউকে এগিয়ে রাখা কিংবা কাউকে পিছিয়ে রাখার কোনো অবকাশ নেই। সবাই জাতীয় দলের খেলোয়াড়। দেশের সেরা খেলোয়াড় বলেই জাতীয় দলের খেলোয়াড়। টিম ম্যানেজম্যান্ট যাকে ভালো করবে তাকেই নির্দিষ্ট দিনে খেলাবে। তবুও নির্দিষ্ট কোনো দিকে এগিয়ে আছেন সেটা বলতে পারবেন? ইয়াসির আলী: আমি আসলে কোনো তুলনায় যেতে চাচ্ছি না। এভাবে কোনো সময় চিন্তাও করিনি। আমি কারো জায়গায় কিংবা কেউ আমার জায়গায় খেলবে না। আমাকে সুযোগ দিলে আমি যেকোনো জায়গায় খেলতে পারবো ক্যারিয়ারের সবথেকে রোমাঞ্চকর জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনি? এ মুহূর্তে নিজের ক্যারিয়ার গড়ার পিছনে কার অবদানের কথা বলবেন? ইয়াসির আলী: বাবা-মা। তাঁদের অনুপ্রেরণা ছাড়া আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার গড়া হতো না। শারীরিকভাবে স্বাস্থ্যবান। ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য নিত্য দিনই হয়তো কাজ করছেন। কি কি করছেন সেগুলো যদি শেয়ার করতেন। ইয়াসির আলী: পরিশ্রম করে যাচ্ছি রুটিন মাফিক। একটা বিষয়ে আমি পরিস্কার, যত দিন থাকবো ততদিন খেলতে পারব। তাই সেভাবেই পরিশ্রম করছি। জিম ওয়ার্ক, রানিং, ওয়েটিং সবকিছুই আমি ভালোভাবে করছি। নির্দিষ্ট কোনো ডায়েট ফলো করছেন? ইয়াসির আলী: লো ফ্যাটের ডায়েট এখন ফলো করছি। সেটাই মেইন্টেইন করার চেষ্টায় আছি। ব্যাটিংয়ে আপনার সবথেকে অনুপ্রেরণা কে? ইয়াসির আলী: বাংলাদেশের মধ্যে তামিম ইকবাল ভাই। দেশের বাইরে ড্যামিয়েন মার্টিন। কারো ব্যাটিং ফলো করেন? ইয়াসির আলী: ড্যামিয়েন মার্টিন। আপনার সবথেকে প্রিয় প্রতিপক্ষ কে? ইয়াসির আলী: এখনও সেই অনুভূতিগুলো কাজ করছে না। আগে খেলা শুরু করি। অধিনায়ক মাশরাফির সঙ্গে কথা হয়েছে? ইয়াসির আলী: দলে সুযোগ পাওয়ার পর কথা হয়নি। এর আগে হয়েছে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ এপ্রিল ২০১৯/ইয়াসিন