খেলাধুলা

এমএস ধোনি: রূপকথার রাজা, স্বপ্নের বাজিকর 

আলাদীনের প্রদীপ হাতে নিয়ে তিনি জন্ম নেননি। অত্যন্ত সাধারণ ঘরের ছেলে। সাধারণ ঘরের ছেলে হয়েও যে কতটা অসাধারণ হয়ে ওঠা যায়, তা শুধু তাকে দেখলেই বোঝা যায়। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ ছাড়া জন্ম নেওয়া সেই ছেলেটি প্রমাণ করেছে মেধা, মনন ও পরিশ্রমের কারণে সকল কিছু অর্জন করা সম্ভব। চাইলে আকাশও ছোঁয়া যায়!

বলছিলাম মাহেন্দ্র সিং ধোনির কথা। তাকে অনেক বিশেষণেই ভূষিত করা যাবে। এই যেমন: ‘মাহেন্দ্র সিং ধোনি ফিনিশেস অফ ইন স্টাইল। হোয়াট আ ম্যাগনিফিসেন্ট স্ট্রাইক ইনটু দ্য ক্রাউড। ইন্ডিয়া লিফট দ্য ওয়ার্ল্ডকাপ আফটার টোয়েন্টি এইট ইয়ার্স। পার্টি স্টার্টস ইন দ্য ড্রেসিং রুম, ইন ইন্ডিয়া।’

প্রায় দেড়শ কোটি মানুষের দেশ ভারত। দেশটি ১৯৮৩ সালের পর ২৮ বছর আলো ঝলমলে একটি রাতের অপেক্ষায় ছিল। যে রাতে ঘরে ঘরে হোলি উৎসব হবে, পাড়ায় পাড়ায় আতশবাজি পুড়বে, মণ্ডপে হবে বিশেষ পূজা অর্চণা। ২৮ বছর অপেক্ষার অবসান হল ২০১১ সালে। রাতের আলোয় মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারার সঙ্গে জ্বলে উঠল পুরো ভারত। পুরো দেশ হয়ে উঠল প্রাণবন্ত। সঞ্চার পেল স্থির হয়ে থাকা প্রতিটি হৃদস্পন্দন!

সে বছর বিশ্বকে অবাক করে ভারত ঘরে তুলে নেয় স্বপ্নের বিশ্বকাপ। নিউক্লিয়াস হলো জীবদেহে কোষের প্রাণ। টিম ইন্ডিয়ার নিউক্লিয়াস ছিলেন মাহেন্দ্র সিং ধোনি। কপিল দেবের পর ভারতের একমাত্র অধিনায়ক যিনি ভারতকে দিয়েছেন গৌরবের ট্রফি, ঐশ্বর্যের ছোঁয়া। অত্যন্ত সাধারণ মাহেন্দ্র সিং ধোনি করে দেখিয়েছেন অসাধারণ ঈর্ষণীয় সব কীর্তি।

শুধু কি একটি বিশ্বকাপ? মোটেও না! ‘ক্যাপ্টেন কুল’ খেতাব পাওয়া ধোনি ভারতকে দিয়েছেন তিনটি শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। ২০১১ বিশ্বকাপের আগে ২০০৭ সালে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে নেন ধোনি। ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপাও ওঠে তার আগে। ‘বাজিকর’ শব্দটি ধোনির নামের পাশে বহুবার বসিয়েছেন ক্রিকেটবোদ্ধারা।

২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে এর শুরু। মিসবাহ-উল-হকের সামনে শিরোপা নির্ধারণী শেষ ওভারে ধোনি বল তুলে দেন আনকোড়া জোগিন্দর শর্মার হাতে। বর্তমানে পুলিশের চাকরি করা জোগিন্দর শর্মা নিজেও জানতেন না ফাইনালের মঞ্চে নায়ক হতে পারবেন তিনি। কিন্তু ধোনির দূরদর্শীতায় সেবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম শিরোপা উঠে ভারতের ঘরে।

২০১১ বিশ্বকাপেও একই চিত্র। ওয়াংখেড়েতে ফাইনাল ম্যাচে টুর্নামেন্ট সেরা নির্বাচিত হওয়া যুবরাজ সিংকে টপকে ধোনি ব্যাটিংয়ে নামেন। অথচ টুর্নামেন্টের শুরু থেকে তার ব্যাটিং ইনিংসগুলো ছিল এরকম: ৩১, ৩৪, ১৯, ১২, ২২, ৭ ও ২৫। বাংলাদেশের বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচে আবার মাঠেও নামেননি। সব মিলিয়ে ধোনির পারফরম্যান্স আহামরি ছিল না। কিন্তু সেই ধোনি নিজেকে উপরে নিয়ে এসে ৯১ রানের অসাধারণ, মহাকাব্যিক ও নান্দনিক ইনিংস খেলে ভারতকে ২৮ বছর পর ওয়ানডে বিশ্বকাপের স্বাদ দেন। কেন ধোনি উপরে এসেছিলেন? উত্তরটি পাওয়া গেল ধোনির জীবন নিয়ে তৈরি হওয়া চলচ্চিত্র ‘এম এস ধোনি: আনটোল্ড স্টোরি’তে। পাঠক, চলুন চলচ্চিত্রটি থেকেই শুনে নেই এর কার্যকারণ।

ধোনি: গ্যারি, (ভারতের তৎকালিন কোচ গ্যারি ক্রিসটেন) প্লিজ টোল্ড ইউভি (যুবরাজ সিং) ইফ উইকেট গোজ ডাউন আই ইউল গো। 

গ্যারি: আর ইউ সিউর?

ধোনি: ইয়াহ…ইটস মুরালি। প্লিজ টোল্ড ইউভি আই উইল গো।

এরপর বাকিটা ইতিহাস। কুলাসেকারেকে ছয় মেরে ভারতকে দেন শিরোপার স্বাদ। দুই বছর পর ধোনির হাত ধরে আসে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা। এখানেও ধোনি অপরাজেয়, অপ্রতিরোধ্য। প্রথম ৩ ওভারে ২৭ রান খরচ করা ইশান্ত শর্মাকে ১৮তম ওভারে বল তুলে দেন ধোনি। ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ১৮ বলে ২৮। ডানহাতি এ পেসারের থেকে বড় কিছুর প্রত্যাশা ছিল ধোনির! বড় চুলের ইশান্ত প্রয়োজন মেটান ধোনির, টিম ইন্ডিয়ার। এউইন মরগান ও রবি বোপারার উইকেট উপহার দেন ইশান্ত। এরপর আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি ইংল্যান্ড। ‘বাজিকর’ ধোনি শেষ বাজিতেও বাজিমাৎ করেন।

ধোনি কি সত্যিই ‘বাজিকর’? ইশান্তকে বল দেওয়ার আগে ধোনি পুরো টিমকে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর কিন্তু আমাদের আজ বাঁচাতে আসবে না। নিজের খেলাটা খেল। জয়টা আমরাই পাবো।’

ছেলেদের উদ্ধুদ্ধ করে মাঠের লড়াইয়ে ধোনি নিজেকে কিংবদন্তির কাতারে নিয়ে গেছেন। একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে আইসিসি ইভেন্টের তিনটি শিরোপা পেয়েছেন ধোনি। ভারতকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ সম্মান। কিন্তু ধোনি কখনোই তার প্রাক্তন ও বর্তমান সতীর্থদের কাছ থেকে যথাযোগ্য সম্মান পাননি!  এ নিয়ে কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার গৌতম ভট্টাচার্য ফেসবুক লাইভে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘মাহেন্দ্র সিং ধোনি ব্যক্তিগতভাবে সফল অধিনায়ক কিন্তু সফল নেতা নন। মাঠের বাইরে খুব বেশি অধিনায়কত্ব করেছেন বলে শুনিনি। অধিনায়ক দুই প্রকৃতির। যে মাঠে অধিনায়কত্ব করবে, পাশাপাশি মাঠের বাইরে ‘বড়-দা’ মত থাকবে। ‘বড়-দার’ ভূমিকায় ধোনি উত্তীর্ণ হতে পারেননি। এজন্য অনেক ক্রিকেটারের কাছেই মাঠের বাইরে ধোনি অজানা। মাঠের বাইরে তাকে অনেকেই চেনেও না।’’

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও আইপিএল চলাকালীন রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে বলেছিলাম, ‘আপনি ধোনিকে একটা ফোন করে কিংবা ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে কেন জিজ্ঞেস করছেন না আপনার কী সমস্যা হচ্ছে?’ উত্তরে অশ্বিন আমায় বলেছিলেন, তার কাছে ধোনির ফোন নম্বর নেই! আমার কাছে কথাটি সেদিন অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল! কিন্তু অশ্বিন আমাকে বলেছিলেন, তিনি যে কোনো কিছুর বিনিময়ে ‘কসম’ কাটতে পারবেন যে তার কাছে আসলেই ধোনির মোবাইল ফোন নম্বর নেই। 

এমন পরিস্থিতিতে সচরাচর মাঠের বাইরে অধিনায়কের সঙ্গে খেলোয়াড়ের যোগাযোগ না থাকলে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ধোনি তো সম্মান দেখিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সৌরভ গাঙ্গুলীর বিদায়ী টেস্টে ধোনি দাদাকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘শেষ সময়টায় আপনি অধিনায়কত্ব করুন। চিরজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’ গাঙ্গুলী হাসিমুখে মেনে নিয়েছিলেন। সাদা পোশাকে ক্যারিয়ারের শেষ পাঁচ মিনিট ধোনি গাঙ্গুলীকে দিয়েছিলেন যথাযোথ্য সম্মান। সেই গাঙ্গুলী অবসর নেওয়ার পর থেকেই ধোনি ভারতকে এক হাতে টেনে তুলেছেন। শেবাগ, দ্রাবিড়, লক্ষণ, হারভাজন সিংদের মতো পরীক্ষিত পারফর্মারদের ‘ছেঁটে’ ফেলতে পিছুপা হননি ধোনি। চাপ নিয়েছেন সেই চাপ জয়ও করেছেন হাসিমুখে।

চাপ জয় করার অভ্যাস ধোনির বাল্যকাল থেকেই। রেলওয়ের চাকরি ছেড়ে যখন ধোনি প্রথম ‘এ’ দলে সুযোগ পেলেন তখন ধোনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নিজের মেধার সঠিক মূল্যায়ন করা উচিত প্রতিটি মানুষের। পরিবার থেকে হাজারো চাপ ছিল ধোনির উপর কিন্তু সেই চাপ ধোনি জয় করেছিলেন। এক জায়গায় ধোনি বলেছিলেন, ‘১০০ কেজি ওজন আপনার ওপর চাপিয়ে দিয়ে যদি আপনাকে বলি আপনি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দেখান এবং আপনি যদি সেটা করে দেখান তাহলে আপনার ওপর সম্মান অনেক বেড়ে যাবে।’

ভারতের হয়ে সবকিছুই করেছেন ধোনি। ভারত সবচেয়ে বেশি জয়ও পেয়েছে তার অধিনায়কত্বে। ২০০ ওয়ানডেতে ধোনির জয় ১১০টিতে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে কোনো অধিনায়কের এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জয়ের রেকর্ড। ধোনির উপরে আছেন শুধু রিকি পন্টিং (১৬৫ জয়)। আর টেস্টে ধোনির নেতৃত্বে ৬০ ম‌্যাচে ২৭টি জিতেছে ভারত। যা এখনও সবার উপরে। 

প্রশ্ন উঠতেই পারে অধিনায়ক ধোনির ব্যক্তিগত রেকর্ড কী? অধিনায়ক হিসেবে ২০০ ওয়ানডেতে ধোনির ব্যাট থেকে এসেছে ৫৩.৫৫ গড়ে ৬৬৪১ রান। অধিনায়ক ছাড়া ১৫০ ওয়ানডেতে ৪৬.৪২ গড়ে ধোনির রান ৪১৩২। অধিনায়ক হিসেবে ভারতকে সরাসরি ১৫টি ম্যাচ জিতিয়েছেন ধোনি। 

‘কে কতো বড় ক্রিকেটার। কার প্রোফাইল সমৃদ্ধ সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফিটনেস গুরুত্বপূর্ণ। তবে ফিট থাকার জন্য আপনাকে প্রতিদিন জিমে যেতে হবে না। ফিটনেস লুকানোটাও ভালো কথা নয়। লুকালে সেটা সবাই ঠিকই বুঝে নেবে।’- ফিটনেস, এই একটি জিনিসের কারণে ধোনির গুডলিস্ট থেকে বাদ পড়েছেন সিনিয়র অনেক ক্রিকেটার। ২০১১ বিশ্বকাপকে ধোনি নিয়েছিলেন নিজের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে। সেটা মেনেই ধোনি এগিয়ে গেছেন। বাঁধা অতিক্রম করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘ধোনি কেন সেরা?’

ধোনি কেন ধোনি? আজকের এ পর্যায়ে আসতে ধোনি কী করেছেন? কীভাবে নিজেকে তৈরি করেছেন? নিখুঁত কোনো টেকনিক কখনোই ছিল না ধোনির। কিন্তু ফল পেয়েছেন নিয়মিত। নিজের জীবন নিয়ে ধোনির সেরা উদ্ধৃতি, ‘টিল দ্য ফুল স্টপ ডাজেন্ট কাম দ্য সেনটেন্স ইজ নট কমপ্লিট।’ অর্থ্যাৎ দাড়ি না দেওয়া পর্যন্ত বাক্য শেষ হয় না। জীবনটাও তাই। সংগ্রামী জীবনে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট না পেলে জীবনটাই অধরা।

ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক ধোনি। তাকে সবাই এভাবেই মূল্যায়ন করেন। তাইতো বলা হয়, ‘ধোনি ইজ দ্য ক্যাপ্টেন অব দ্য বেস্ট ইন্ডিয়ান টিম।’ তিনি ভারতের রূপকথার রাজা, স্বপ্নের বাজিকর।