খেলাধুলা

যে ১৩ দফা দাবিতে আন্দোলনে গিয়েছিলেন সাকিবরা

২১ অক্টোবর ২০১৯। হঠাৎ-ই খবরটা আসে। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসছেন ক্রিকেটাররা। বোর্ডের সঙ্গে ক্রিকেটারদের বিদ্রোহ- এ গুঞ্জন চলতে থাকে সংবাদকর্মীদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত সংবাদ সম্মেলনে বিসিবির কাছে ১১ দাবি পেশ করে ধর্মঘটের ডাক দেন ক্রিকেটাররা। ২৪ ঘণ্টা পর যুক্ত করা হয় আরো দুই চাওয়া।

পরবর্তীতে দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিসিবির সঙ্গে আলোচনায় বসে সমঝোতা করেন ক্রিকেটাররা। দ্রুতই মাঠে ফেরেন তারা। যে ১৩ দফা দাবি তুলেছিলেন ক্রিকেটাররা

দাবি ১, আমাদের প্রথম দাবি হচ্ছে কোয়াব (ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) বিলুপ্তি করতে হবে। বর্তমানে এর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। কোয়াব ক্রিকেটারদের প্রতিনিধি হলেও ওইভাবে কখনোই আমরা আমাদের পাশে তাদের পাইনি। আমাদের প্রথম দাবি হচ্ছে কোয়াবের প্রেসিডেন্ট (নাঈমুর রহমান দূর্জয়) এবং সেক্রেটারিকে (দেবব্রত পাল) পদত্যাগ করতে হবে। কোয়াবের কে প্রেসিডেন্ট বা কে সেক্রেটারি হবেন, তা আমরা ক্রিকেটাররা বাছাই করব।

দাবি ২, গত কয়েক বছর ধরেই আপনারা জানেন প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের পরিস্থিতি কেমন। সব ক্রিকেটারই এ ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করছে- যেভাবে প্রিমিয়ার লিগ হচ্ছে। কারণ এখানে পারিশ্রমিকের একটা মানদণ্ড বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। খেলোয়াড়রা আগে বাছাই করতে পারত, কোন দলে খেলবে, পারিশ্রমিক কেমন হবে। আমাদের দাবি হলো আগের মতো যেন প্রিমিয়ার লিগটা ফিরে পাই।

দাবি ৩, আমাদের তৃতীয় দাবি বিপিএল নিয়ে। আমরা জানি, এ বছর বিপিএল অন্যরকম হচ্ছে। সেটা অবশ্যই সম্মান করি। আমাদের প্রধান দাবি হলো, আগের নিয়মের বিপিএল যেন আগামী বছর থেকে চলে আসে। আর মূল দাবি হলো, বিদেশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে আমাদের স্থানীয় খেলোয়াড়দের অনেক পার্থক্য থাকে। আগামীতে যেন সামঞ্জস্য থাকে। এটা নিশ্চিত করতে হবে আমাদের স্থানীয় ক্রিকেটাররা যেন সেই পারিশ্রমিক পায়। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্বে অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ হয়, খেলোয়াড়রা তাদের ড্রাফট বেছে নিতে পারে, কোন গ্রেডে থাকবে। আমার মনে হয় বাংলাদেশে খেলোয়াড়দের গ্রেড নির্বাচনের সুযোগ দেওয়া উচিত। এরপর যদি কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি না নেয় তাহলে সেটা আলাদা ব্যাপার।

দাবি ৪, আমরা সবাই মিলে মনে করেছি এটা (প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি) এক লাখ টাকা হওয়া উচিত। আমাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের বেতন পঞ্চাশ ভাগ বাড়াতে হবে। খেলোয়াড়দের প্র্যাকটিস ফ্যাসিলিটিজ বাড়াতে হবে, সেটা জিম, ইনডোর মাঠ- সব জায়গাতেই। ১২ মাস কোচ, ফিজিও, ট্রেনার রাখতে হবে; তারাই আসলে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের একটা পরিকল্পনা দেবেন। আমরা বুঝি, এটা হয়তো আজই হবে না। তবে আগামী মৌসুম থেকে যেন হয়, প্রতিটি বিভাগে।

আমরা চাই না প্রতিটি ট্রেনিং সেশন যেন ঢাকাতেই হয়। যার যার বিভাগে যেন অনুশীলন করতে পারে। টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের ভালো করতে হলে এখানে ভালো বল দিতে হবে। এটা আমাদের অনেক বড় একটা সমস্যা। টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করতে হলে এর গুরুত্ব অনেক।

দাবি ৫, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এখানে অনেকগুলো ছোট ছোট ইস্যু আছে যেগুলো অনেক সময় বলা হয় না। এই জিনিসগুলোর উন্নতি খুব দরকার যদি আমরা ক্রিকেটের সংস্কৃতি ভালো করতে চাই। এখানে প্রথম হচ্ছে বল। আমরা যে বল দিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলি সেটা মানসম্মত হয় না। এমন বলে খেললে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আবার নতুন ধরনের বলের সাথে মানাতে কষ্ট হয়। ক্রিকেটারদের দৈনিক ভাতা ১৫০০ টাকা থেকে বাড়াতে হবে। কারণ বিসিবি যে ফিটনেস লেভেল দাবি করছে ১৫০০ টাকায় পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা হয় না ক্রিকেটারদের। ভেন্যুগুলোতে ক্রিকেটারদের ভ্রমণ খরচ ২৫০০ টাকা থেকে বাড়াতে হবে। বিভাগভিত্তিক যাতায়াতের জন্য বিমান ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে হবে। যে হোটেলের ব্যবস্থা করা হবে সেখানে কমপক্ষে জিম এবং সুইমিং পুল থাকা বাধ্যতামূলক। আপনারা যদি দেখেন মাঠে আমরা কী বাসে চড়ে আসি বা যাই, খুবই হতাশাজনক একটা বিষয়। মাঠে আসার জন্য ক্রিকেটারদের জন্য এসি বাসের ব্যবস্থা করতে হবে।

দাবি ৬, জাতীয় দলের চুক্তিভুক্ত ক্রিকেটারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বিশ্বব্যাপী যদি চিন্তা করেন বাংলাদেশের চুক্তিভুক্ত ক্রিকেটারের সংখ্যা কম। আমাদের কাছে মনে হয় চুক্তিভুক্ত ক্রিকেটারের সংখ্যা ৩০ জন করা উচিত এবং তা করতেই হবে। পাশাপাশি বেতন বাড়াতে হবে। অনেক দিন ধরেই শুনেছি ক্রিকেটারদের বেতন বাড়ানো হয় না। তাই আমাদের কাছে মনে হচ্ছে জাতীয় দলের চুক্তিতে বেতন এবং খেলোয়াড় সংখ্যা বাড়াতে হবে।

দাবি ৭, আমরা যে বিষয়গুলো নিয়ে আজ কথা বলছি সবকিছু ক্রিকেট নিয়ে। শুধু ক্রিকেটারদের নিয়েই নয়। আপনি গ্রাউন্ডসম্যানদের কথা চিন্তা করেন। সে কী ধরনের বেতন পায় বিসিবি থেকে তার কাজ অনুপাতে। সারাদিন মাঠে কাজ করে মাস শেষে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছে। আরেকটা বিষয়, কোচের কথা বলব, আপনি যদি দেখেন আমরা নিজেরাই বাঙালি কোচদের প্রোমোট করতে চাই না। বিদেশি একটা কোচ যে টাকা বেতন পায় আমাদের হয়তো ২০ জন কোচ তা পায় না। এমনও সময় গেছে সম্প্রতি একটা সফরে দেশি কোচের অধীনে দল ভালো খেললেও পরবর্তী সিরিজে তাকে আর দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।

আম্পায়ারিং নিয়ে একটু বলব, আম্পায়ারিং নিয়ে আমরা সবাই অভিযোগ করি। আম্পায়ারদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে টাকা দিয়ে। আমরা তা দেই কি দেই না এটা আপনারা সবাই জানেন। আপনারা সবাই জানেন তাদের কী ধরনের বেতন দেওয়া হয়। ফিজিও, ট্রেনার সবার ক্ষেত্রে একই। এখন উপযুক্ত সময় বাংলাদেশিদের প্রাধান্য দেওয়ার।

দাবি ৮, আমরা দুটো চার দিনের আসর খেলি, বিসিএল এবং এনসিএল। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগের ওয়ানডে ভার্সনে আমরা মাত্র একটি আসর খেলি (ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ) । আমাদের আরেকটি আসর বাড়ানো উচিত। বিপিএলের মাধ্যমে আমরা একটি টি-টোয়েন্টি লিগই খেলি। এছাড়া কোনো টি-টোয়েন্টি আসর হয় না।

আমার কাছে মনে হয় বিপিএলের আগ মুহূর্তে একটি টি-টোয়েন্টি আসর হওয়া জরুরি। যাতে আমাদের বিপিএল আরও ভালো যায়। ওয়ানডের ব্যাপারে যেটা বলব আগে আমাদের জাতীয় লিগের আগে ওয়ানডে একটি খেলা হতো। পাঁচ বছর আগেও হতো। চার দিনের ম্যাচ খেলে আমরা একটি ওয়ানডে খেলতাম। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা চাই জাতীয় ক্রিকেট লিগের একটি ওয়ানডে আসর চালু করা হোক।

দাবি ৯, ঘরোয়া আসরের ক্ষেত্রে আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট ক্যালেন্ডার থাকতে হবে। তাতে আমরা যেন প্রস্তুতি নিতে পারি সারা বছরের।

দাবি ১০, দশ নম্বর পয়েন্ট হচ্ছে বিপিএল-প্রিমিয়ার লিগের টাকাটা আমরা যেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাই। যেমন শেষ প্রিমিয়ার লিগে আমরা যারা ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে খেলেছি, এখনো ৪০ ভাগ টাকা পাই নাই। বোর্ডে অনেকবার যাওয়া হয়েছে, কোয়াবকেও অনেকবার বলা হয়েছে। জাতীয় দলের ক্রিকেটার হিসেবে এটা আমাদের প্রাপ্য না। আমাদের দলের অনেক ক্রিকেটারই যাওয়া-আসা করে। এটা খুবই দৃষ্টিকটু। তো আশা করব, যে সময় দেওয়া থাকে সে সময়ের মধ্যে যেন পাই।

দাবি ১১, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের একটি নিয়ম বেঁধে দেওয়া আছে যে দুটির বেশি খেলতে পারব না। এখন জাতীয় দলে খেলার বাইরে যে সময়টা আমরা পাই তখন যদি আমরা ফ্রি থাকি তাহলে যেন বাইরে খেলতে যেতে পারি, তাহলে আমাদের খেলাও হবে, অনেককিছু শেখাও হবে।

দাবি ১২, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার অব্যহত থাকলে আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে ভারতের পর বাংলাদেশ ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বানিজ্যিক বাজার হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। সময়ের ব্যবধানে আমাদের জনসংখ্যা, ক্রয়ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিবেচনায় এমনটা হতে পারে। কর্পোরেট ক্রিকেটে এমন উন্নতির সঙ্গে ক্রিকেটারদের ঘাম জরিয়ে রয়েছে। তাই রাজস্ব আয়ে আমরা একটা স্বচ্ছ অংশ চাই। প্রফেশনাল ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সমঝোতা করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড লাভের একটা অংশ ক্রিকেটারদের দিবে।

দাবি ১৩, বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটারা সম্প্রতি ভালো পারফর্ম করছে। পুরুষদের মতো নারীদের ক্রিকেটেও এই সংস্কারগুলো হওয়া দরকার। বানিজ্যিক ক্ষেত্রে নারীদেরও তাদের লাভের হিস্যা দিতে হবে। ক্রিকেট লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে পুরুষ ক্রিকেটাররা যে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে তার সব দিতে নারী ক্রিকেটারদেরকেও।