খেলাধুলা

‘সেই ইনিংসের জন্যই আজকের আমি’

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে মানুষের জটলা। শাহবাগে সাদা পোশাকে মিছিল। পল্টন পেরিয়ে বায়তুল মোকাররামের সামনে হাজার হাজার মানুষ। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মিলে যায় সবার পথ।

২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। প্রথম টেস্ট খেলতে নামছে বাংলাদেশ। ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে থেকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ২০ মিনিটের পথ দূর্জয়, আকরাম, হাবিবুলরা পাড়ি দেন এক ঘণ্টায়। বাংলাদেশ টেস্ট খেলতে নামছে, উৎসবে ভেসে যায় গোটা দেশ। আনন্দ ছুঁয়ে যায় সেই ১৫ সৈনিককেও, যারা মাঠে নামছেন ইতিহাসের সাক্ষী হতে।

দুই দশক পেরিয়ে গেছে। তবুও সবকিছু যেন এখনও তরতাজা হাবিবুল বাসার সুমনের স্মৃতির পাতায়। তাইতো স্মরণীয় দিনটির কথা উঠতেই খুলে দিলেন কথার ঝাঁপি। রাইজিংবিডিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাবিবুল ফিরে গেলেন ২০ বছর আগে।

রাইজিংবিডি: শুরুতেই জানতে চাইব টেস্ট অভিষেকের আগের রাতের পরিবেশ সম্পর্কে। সকাল হলেই সাদা জার্সিতে মাঠে নামবেন। রাতে কেটেছিল কিভাবে?

হাবিবুল বাশার: নিজের মধ্যে টেনশন কাজ করছিল, তবে এক্সাইটেডও ছিলাম খুব। সারারাত ঘুম হয়নি। এমনকি খাওয়া দাওয়াতেও বিশৃংখলা হয়েছিলো। আসলে পরের দিন টেস্ট ক্রিকেটার হয়ে যাবো, এটা আমার জন্য বিরাট বিষয় ছিল। আমার রুমমেট সাধারণত আল শাহরিয়ার রোকন হতো। নির্ঘুম রাত কাটালেও অবশ্য আমি তাকে জ্বালাইনি। আগে আগেই শুয়ে পড়েছিলাম দুজনে।

রাইজিংবিডি: সকাল হলো, মাঠে গেলেন কেমন লাগছিল?

হাবিবুল বাশার: গ্যালারি ভরা মাঠে এর আগেও খেলা হয়েছিল। তবে এদিন আবহাওয়াটা অন্যরকম ছিল। প্রধানমন্ত্রীও এসেছিলেন। আসলে আমার জন্য এটা অন্যরকম এক আবহ ছিল। আমার জন্য অনেক কিছুই প্রথম ছিল। তবে যারা আইসিসি খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছিলেন, তাদের কাছে এমন মুহূর্ত চেনা ছিল।

রাইজিংবিডি: পুরো দেশ আপনাদের দিকে তাকিয়ে। বাংলাদেশ এর আগে ১৯৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছিল। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানকেও হারালাম, তাও বিশ্বকাপে। ক্রিকেটের প্রতি মানুষের আগ্রহ তখন ধীরে ধীরে শুরু হলো। মনে করতে পারবেন হোটেল থেকে মাঠে ঢোকা পর্যন্ত দর্শকদের উন্মাদনা কেমন দেখেছিলেন?

হাবিবুল বাশার: আমরা তো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ছিলাম। আমরা সকালেই পুলিশি পাহারায় মাঠের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। তখনই দেখেছিলাম দর্শক, সমর্থকদের উল্লাস। খেলা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। সেখানে টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছিল পুরানা পল্টনে। আমরা যখন মাঠে প্রবেশ করবো, তখন সেই লাইনটা ছিল বায়তুল মোকাররম পর্যন্ত। বলা চলে হোটেল থেকে যখন বের হই, তখন থেকেই টেস্ট ক্রিকেটের আমেজে ঢুকে যাই।

রাইজিংবিডি: আগের দিন তো ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে অনুশীলন করছিল। বাংলাদেশ একেবারেই নতুন, ভারত অভিজ্ঞ। অনুশীলনের আগে কি ওদের সঙ্গে টুকটাক কথা হয়েছিল?

হাবিবুল বাশার: না, তেমন কিছু ঘটেনি। আসলে আমি নিজেও ক্রিকেট ক্যারিয়ারে খুব বেশি পরামর্শ নেইনি কারো। সেই ম্যাচের আগেও না। তবে তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল যখন, তখন হাই হ্যালো তো হতোই। তারা আমাদের প্রথম ম্যাচ উপলক্ষে স্বাগতম জানিয়েছিল, শুভেচ্ছা দিয়েছিল। তারা আসলে প্রথম টেস্টের আগে মাঠের বাইরে আমাদের কঠিন সময় উপহার দেয়নি।

রাইজিংবিডি: উদ্বোধনী টেস্টের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি কোনটা বলবেন?

হাবিবুল বাশার: অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীকে কাছ থেকে দেখতে পাওয়া, ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য। আসলে আমি ’৯৯ বিশ্বকাপ কিংবা ’৯৭ এর আইসিসি ট্রফি খেলিনি। তো আমার জন্য দলের সঙ্গে এটা অনেক বড় একটা সুযোগ ছিল। হেলিকপ্টারে করে প্যারাট্রুপার নেমেছিল, এটা আমার জন্য অনেক বড় বিষয় ছিল। আমার জন্য আরেকটি বিষয় খুব স্পেশাল ছিল। সেটি হচ্ছে যখন হোটেল থেকে বেরুচ্ছিলাম, তখন দর্শকদের যে উন্মাদনা; যেমন মিছিল করা, আমাদের দেখে হাত নাড়ানো। এটাও আসলে আমাদের কাছে দারুণ লাগছিল। নিজেকে স্পেশাল মনে হচ্ছিল।

রাইজিংবিডি: বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট হাফ সেঞ্চুরি আপনার। এটা আজীবন আপনারই থাকবে। এই ভাবনাটা কেমন লাগে?

হাবিবুল বাশার: আমি তো ক্যারিয়ারে অনেক ফিফটি করেছিলাম। সেগুলোর জন্য আমার দুঃখ আছে। কিন্তু ওই ফিফটির জন্য আমার কোনো আফসোস নেই। হুম, সেঞ্চুরি পেলে বেশি ভালো লাগতো। তবে সেই ম্যাচে আমি ভালো ব্যাটিং করেছিলাম। যা ওদেরও কিছুটা চমকে দিয়েছিল। আমরা শুরুতে একটু ধীরস্থির খেলছিলাম, এরপর আমি গিয়ে যেভাবে কাউন্টার অ্যাটাক করে খেলেছিলাম। এটা ওরাও হয়ত আশা করেনি। আমার কাছে এই ইনিংসটা খুব স্পেশাল। আমি এমন ইনিংস খেলতে পেরে অনেক বেশি খুশিও ছিলাম। আমি হয়ত ৭০ করে (আসলে ৭১) আউট হয়েছিলাম। শতক পাওয়া উচিত ছিল। কারণ ভালো ব্যাটিং করছিলাম। খুব একটা সংগ্রামও করতে হয়নি। কিন্তু সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত আমি খুশি। কারণ, আমার এই ইনিংস আমাকে এই পর্যায়ে পরবর্তী সময়ে ভালো খেলার আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। এমনকি এটা নিজেকে প্রমাণের ইনিংসও ছিল। একাদশে সুযোগ পাওয়া, পারফর্ম করা দারুণ বিষয় ছিল আমার জন্য।

রাইজিংবিডি: জেদ থেকেই কি আপনার ৭১ রান?

হাবিবুল বাশার: সত্যি কথা বলতে ব্যাটিংয়ের সময়ে কোনো জেদ কাজ করেনি। এটা ছিল, নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করা। আমার কাছে আসলে পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে কে আমাকে কি বলেছে, সেটা নিয়ে ভাবিনি। বরং নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করাটাই আমার কাছে আসল ছিল।

রাইজিংবিডি: ওই ম্যাচের আগে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ১৪৩ রান আপনার ছিল। তো এরপরেও শুরুতে দলে সুযোগ না পাওয়া কী আপনার জন্য কষ্টের ছিলো না?

হাবিবুল বাশার: টেস্ট ক্রিকেটে না খেলতে পারাটাই তো কষ্টের। তবে যেহেতু খেলতে পারছি তাই কষ্ট নাই। তবে হ্যাঁ, এর আগে ’৯৭ এর আইসিসি ট্রফিতে না খেলতে পারা, ’৯৯ বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা আমার জন্য অনেক কষ্টের ছিল। ’৯৫ সালে অভিষেকের পর ৫ বছর লেগেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেকে প্রমাণ করতে এটাও কষ্টের ছিল কিছুটা। ফলে না খেলতে পারলে কষ্ট পেতামই। কিন্তু খেলতে পারায় অতীত নিয়েও খুব একটা আক্ষেপ নাই। আসলে এরপর থেকে নিজের যোগ্যতায় টানা দলের হয়ে খেলতে পেরেছিলাম, এই পর্যায়ে এসে এটা আমাকে ভালো অনুভূতি দেয়।

রাইজিংবিডি: ওই টেস্টে এমন কোনো স্মৃতি আছে, যেটা এখন পর্যন্ত বলা হয়নি?

হাবিবুল বাশার: না। আসলে ওই টেস্ট নিয়ে আমি এত কথা বলেছি, যে কিছুই মনে হয় বলার বাকী নাই। প্রথম ইনিংস, দ্বিতীয় ইনিংস দুটোতেই ভালোই খেলেছিলাম। তাই টেস্টটি নিয়ে অনেক কথা বলেছি। কিছুই বলার বাকী নাই।

রাইজিংবিডি: আমরা যে পটেনশিয়াল নিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করেছিলাম, আমরা কী ২০ বছর পর সেই পথে আছি? বা লক্ষ্যের ধারে কাছে পৌঁছাতে পেরেছি?

হাবিবুল বাশার: আমরা এখনো অধারাবাহিক। ধারেকাছে আছি কিনা, সেটা নিয়ে কিছু বলবো না। তবে এখন আমাদের দলে কিন্তু অনেক পারফরমার বেড়েছে। শতক পাওয়ার মতো অনেক ব্যাটসম্যান আছে। পাঁচ উইকেট পাওয়ার মতো খুব বেশি বোলার না থাকলেও বোলিং ডিপার্টমেন্ট একদম খারাপও না। এখনো আমরা অধারাবাহিক, এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিন্তু এছাড়া আমরা ভালোই উন্নতি করেছি। তবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি সেটা বলতেই হয়। আমরা সেই পথে আছি, এটুকু বিশ্বাস করি।