খেলাধুলা

ছন্দ হারিয়ে ছন্দে ফেরার প্রথম দিন

তাইজুল ইসলামের বলে সোজাসুজি ব্যাট চালান ক্রিজে থিতু হওয়া জার্মেইন ব্ল্যাকউড। ডান দিকে ঝাঁপিয়ে এক হাতে বল তালুবন্দি করেন এই স্পিনার। হাতে ভর দিয়ে মাটিতে থাকা অবস্থায় ব্ল্যাকউডের দিকে রুদ্রমূর্তিতে তাইজুল তাকিয়ে থাকেন । যেন ক্ষ্যাপাটে বাঘ!

তাইজুলের এমন রুদ্রমূর্তি প্রথম দিন জুড়ে পুরো দলের ছিল, এমন কিছু ভাবলে ভুল হবে। চট্টগ্রামে প্রথম টেস্টে হারের ক্ষত নিয়ে দ্বিতীয় টেস্টে সিরিজ বাঁচানোর লড়াইয়ে খেলতে নেমে শারীরিক-মানসিকভাবে খুব একটা চাঙ্গা দেখা যায়নি মুমিনুল হকদের।

বৃহস্পতিবার মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টস হেরে ফিল্ডিং করে বাংলাদেশ। লাল সবুজের প্রতিনিধিদের কাছে দিনটি ছিল ছন্দ হারা আর ছন্দে ফেরার। প্রথম সেশন পুরোটা কর্তৃত্ব করে সফরকারীরা। দ্বিতীয় সেশনে এই টেস্টে একাদশে জায়গা পাওয়া আবু জায়েদ রাহী-সৌম্য সরকারের আক্রমণে ছন্দে ফেরে বাংলাদেশ। আবার তৃতীয় সেশনে এনক্রুমাহ বোনার দিনের নাটাই নিয়ে নেন নিজেদের হাতে। এভাবেই শেষ হয় সিরিজ নির্ধারণী টেস্টের প্রথম দিন।

টেস্টের প্রথম দিন বাংলাদেশের অর্জন ৫ উইকেট। অতিথিদের স্কোরবোর্ডে পুঁজি ২২৩ রান। ক্রিজে আছেন চট্টগ্রাম টেস্টে জয়ের অন্যতম নায়ক বোনার। হাফসেঞ্চুরিকে সেঞ্চুরিতে রূপ দেওয়ার অপেক্ষায় থাকা ডানহাতি ব্যাটসম্যান অপরাজিত ৭৪ রানে। সঙ্গে আছেন জশুয়া ডা সিলভা (২২*) ।

দুই দলেই এসেছে একাধিক পরিবর্তন। সাকিব আল হাসান ও সাদমান ইসলামের জায়গায় এসেছেন মোহাম্মদ মিথুন ও সৌম্য। কেমার রোচকে হটিয়ে উইন্ডিজ একাদশে জায়গা করে নিয়েছেন আলজারি জোসেফ।

দিন শেষে হাসিমুখে ড্রেসিংরুমে ফিরলেও সকালটা ছিল ভিন্ন। প্রথম সাফল্য পেতে পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয় পাক্কা ৮৮ মিনিট। রাহীর করা ইনিংসের প্রথম বলে কাভার পয়েন্টে ঠেলে ২ রান, ২ বল ডট দিয়ে চতুর্থ বলে চার; এভাবেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসের সূচনা করেন অধিনায়ক ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট। সেই যে শুরু হলো এরপর ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন দুই ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যান। মিরাজ, তাইজুল ও নাঈম হাসানের গড়া স্পিন আক্রমণ ভালোভাবে সামলে প্রতি আক্রমণে এগিয়ে যান তারা।

তাইজুলের হাত ধরে আসে ব্রেক থ্রু। তাতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে বাংলাদেশ। তার বলে সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হন ৩৬ রান করা ক্যাম্পবেল। যদিও ইনিংসের শুরুতে রাহীর বলে এলবিডব্লিউ হয়ে রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। প্রথম সেশনে বাংলাদেশের সাফল্য ক্যাম্পবেলের উইকেট।

মধ্যাহ্ন বিরতির পর বাংলাদেশ দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। এ সেশনে মাত্র ৬২ রানে পায় ৩ উইকেট। যার শুরুটা শেন মোসলেকে দিয়ে। মোস্তাফিজুর রহমানের বিশ্রামে সুযোগ পাওয়া রাহী আঘাত করেন অতিথি শিবিরে। দলের প্রধান টেস্ট বোলার হয়েও চট্টগ্রাম টেস্টে বসে ছিলেন ড্রেসিংরুমে। প্রথম সেশনে তাকে খাপছাড়া দেখাচ্ছিল, তবে দ্বিতীয় সেশনের শুরু থেকে প্রাণবন্ত দেখায়। রাহীর করা অফস্টাম্পের অনেক বাইরের বল ড্রাইভ করতে গিয়ে ইনসাইড এজ হয়ে ভেঙে যায় মোসলের লেগ স্টাম্প। কিছুক্ষণ পরই সৌম্য হাসায় বাংলাদেশকে।

বাংলাদেশ বাঁচা মরার ম্যাচটিতে নেমেছে তিন স্পিনার ও এক বিশেষজ্ঞ পেসার নিয়ে। ‘কথিত’ পেসার হিসেবে আছেন সৌম্য। কিন্তু অধিনায়ক মুমিনুল হক প্রথম সেশনে বোলিংয়ে আনেননি।  দলের ‘দ্বিতীয় পেসার’ সৌম্য যখন বোলিংয়ে আসেন ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে ৩৭ ওভার। সাফল্যর জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। তৃতীয় ওভারে তুলে নেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উইকেট। ব্র্যাথওয়েট ছড়ি ঘোরাচ্ছিলেন মিরাজ-তাইজুলদের ওপর। পাত্তা দিচ্ছিলেন না রাহীকেও। নিয়মিত বোলাররা যেখানে সাফল্যর দেখা পাচ্ছিলেন না, সেখানে নিজের তৃতীয় ওভারেই ব্র্যাথওয়েটকে সাজঘরে ফেরান সৌম্য। অফ সাইড দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া বল কাট করতে গিয়ে ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক ধরা পড়েন স্লিপে থাকা নাজমুল হোসেন শান্তর হাতে। আউট হওয়ার আগে তার ব্যাট থেকে আসে ১২২ বলে ৪৭ রান। সৌম্যর নিয়ন্ত্রিত বোলিং দেখে আফসোস হতে পারে বাড়তি একজন পেসার না খেলানো নিয়ে!

৬ ওভারের ব্যবধানে রাহীর আবার আক্রমণ। এবার শিকার ‘বিগম্যান’ কাইল মায়ার্স। চট্টগ্রামে অপরাজিত ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে বাংলাদেশ বধের নায়ক এবার আউট মাত্র ৫ রানে। ডানহাতি পেসারের বল ড্রাইভ করতে চেয়েছিলেন মায়ার্স। কিন্তু বল ব্যাটে লেগে সরাসরি যায় স্লিপে দাঁড়ানো সৌম্যর হাতে। ক্রিজে থিতু হওয়া ব্র্যাথওয়েট ও মায়ার্সের উইকেটসহ ৩ উইকেট নিয়ে দ্বিতীয় সেশনে কর্তৃত্ব ফিরে পান মুমিনুলরা।

চট্টগ্রামে মায়ার্স ও বোনার জুটি বাংলাদেশকে কাঁদিয়েছিল। ২১৬ রানের জুটি গড়েছিলেন দুই অভিষিক্ত ক্রিকেটার। এদিন মায়ার্সকে ফেরাতে পারলেও বোনার ছিলে অবিচল। দিনের তৃতীয় ও শেষ সেশনে স্বাগতিক বোলিং আক্রমণকে নির্বিষ করে দেন। প্রথমে ব্ল্যাকউডকে নিয়ে ও পরে ডা সিলভাকে নিয়ে ইনিংস গড়েন তিনি।

দুর্দান্ত ক্যাচে বোনার-ব্ল্যাকউডের গড়া দিনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬২ রানের জুটি ভেঙে দিয়ে আবারও ত্রাতা হয়ে আসেন তাইজুল। ব্ল্যাকউডের ব্যাট থেকে আসে ২৮ রান। এরপরই দেয়াল হয়ে দাঁড়ান বোনার। সঙ্গী ডা সিলভাকে নিয়ে ১০৯ বলে ৪৫ রানের জুটিতে দিন শেষ করে হাসিমুখে, মাথা উচুঁ করে।

বল হালকা টার্ন করলেও প্রথম দিন উইকেট থেকে বেশি সুবিধা পাননি স্পিনাররা। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পিনারদের জন্য সোনায় সোহাগা হয়ে উঠবে মিরপুরের ২২ গজ।

বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ২টি উইকেট নিয়েছেন রাহী ও তাইজুল। ১টি উইকেট নেন সৌম্য। দুই অফস্পিনার ছিলেন উইকেটশূন্য।

দ্বিতীয় দিনের প্রথম সেশন ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিতে পারে। সেজন্য বাংলাদেশকে দ্রুত অতিথিদের গুঁড়িয়ে দিতে হবে। খুঁজে নিতে হবে বোলিং ছন্দ। যে ছন্দে ক্যারিবিয়ানরা হবেন নাকাল। নয়তো রানের পাহাড় গড়তেও পারে ব্র্যাথওয়েটের দল।