খেলাধুলা

ফাল্গুনের প্রথম বিকেলে বসন্ত বিলাপ

চট্টগ্রাম টেস্টে ৩৯৫ রানের টার্গেট দেওয়ার পর ৫৯ রানে বাংলাদেশ ৩ উইকেট তুলে নেওয়ার পর চতুর্থ দিন শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর ১১০/৩। পঞ্চম দিন মাঠে নামার আগের রাতটা কতই না নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলেন মুমিনুল হকের দল! ঠিক সাত দিনের মাথায় ঢাকা টেস্টে ২৩১ রানের লক্ষ্যে নেমে চতুর্থ দিন তারা চা খেতে গেলেন ৩ উইকেটে ৭৮ রানে। আবারও প্রফুল্ল চিত্ত তাদের। কিন্তু দুইবারই তাদের আত্মতৃপ্তি কর্পূরের মতো বাতাসে মিলিয়ে গেলো। আত্মতুষ্টির পরিণতি খুব একটা যে ভালো নয়, তা আবারও প্রমাণিত। দ্বিতীয় সারির ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হোয়াইটওয়াশ! সিরিজ বাঁচাতে না পারার হাহাকার হয়ে রইলো বসন্ত বিলাপ।  

এক রাকিম কর্নওয়ালেই কি শেষ হয়ে গেলো বাংলাদেশ! বলা চলে। অথচ ফার্স্ট স্লিপে দাঁড়ানো এই ‘ফিটনেসহীন’ ক্রিকেটারের চোখ ধাঁধানো ক্যাচ হওয়ার আগে তার দুই ওভারে একটি করে চার ও ছয় মেরে ম্যাচটা ঘুরিয়ে দেওয়ার পথে ছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ১৮৮ রানে নবম উইকেট হারানোর পর আবু জায়েদ রাহীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। আর তো মাত্র ১৭ রান দরকার ছিল। কিন্তু না, মেহেদী এবার পারেননি রাঙাতে। বিকেলে স্পিন যাদুতে মুমিনুলদের কুপোকাত করা কর্নওয়াল দিনটি নিজের করে নিয়েছেন শেষ উইকেটে একেবারে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে থাকা বলটি লুফে নিয়ে। ৩১ রান করা মিরাজের যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না, নড়ার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছেন।   

ফাগুনের প্রথম সকালে আগুনে বোলিং করে দারুণ কিছুর আভাস দিয়েছিলেন রাহী। তাইজুল-নাঈমের ঘূর্ণিতে সফরকারী শিবিরে কাঁপন ধরায় বাংলাদেশ। কিন্তু সকাল-দুপুর পার করে বিকেল না গড়াতেই ফাগুনের হাওয়া বইতে থাকে ক্যারবিয়ান শিবিরে। কর্নওয়ালের সঙ্গে জোমেল ওয়ারিক্যান-ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েটের জাদুতে বসন্ত রুপ নেয় বিস্বাদে।  

লক্ষ্যটা খুব বেশি নয়, ২৩১ রানের। ফুরফুরে মেজাজে খেলতে নেমে আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে রান তাড়া শুরু করেন তামিম-সৌম্য। এই আগ্রাসী মনোভাব যেন কাল হয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত ২১৩ রানে থামে বাংলাদেশের ইনিংস। ১৭ রানে এই ম্যাচ হেরে ২ টেস্টের সিরিজে ধবলধোলাই তারা।

এর মধ্য দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে এশিয়ার মাটিতে প্রতিপক্ষকে প্রথমবার হোয়াইটওয়াশের কৃতিত্ব অর্জন করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের ইতিহাসে এই অর্জন থাকবে অমর হয়ে। অনভিজ্ঞ দল, নেই নিয়মিত অধিনায়ক জেসন হোল্ডারসহ অনেক চেনামুখ। তারপরও বাজিমাত করেছে তারা। মাঠে তাদের গর্জন বুঝিয়ে দেয় অনভিজ্ঞ হলেও তারা সাদাপোশাকের অভিজাত লড়াইয়ে নেমেছেন নানা অঙ্ক কষে।

সিরিজ শুরুর আগে থেকেই আলোচনায় ছিলে দীর্ঘদেহী স্পিনার কর্নওয়াল। বল হাতে জাদু দেখিয়েছেন। ২ টেস্টে নিয়েছেন ১৪ উইকেট। ঢাকা টেস্টেই ৯ উইকেট নিয়ে একাই গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। এই কর্নওয়ালের বোঝা বইতে পারেননি মুশফিক-মুমিনুলরা। এর আগের টেস্টে কাইল মায়ার্স মহাকাব্যে কুপোকাত হলেও সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে নায়ক কর্নওয়াল। ২ ইনিংসে ৯ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন তিনি। ২ টেস্টে ২৩১ রান করে ব্যাট হাতে বাংলাদেশকে ভোগানো এনক্রুমাহ বোনার পান ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার।

বাংলাদেশ এর আগে সর্বোচ্চ ২১৫ রান তাড়া করে জিতেছিল। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওই ম্যাচে জয়ের নায়ক ছিলেন সাকিব আল হাসান। রোববার মিরপুর শের-ই বাংলায় কেউ ‘সাকিব’ হয়ে উঠতে পারেননি। ব্যাট-বল হাতে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করে বিদেশের মাটিতে ইতিহাস গড়েছিলেন। এবার ঘরের মাঠে ছিল সেই বাধা টপকে যাওয়ার সুযোগ। সকালে রাহীর আক্রমণের পর দ্বিতীয় সেশনের ২৩ মিনিট স্বপ্ন দেখায় নতুন ইতিহাসের।  মাঠে নেমেই তামিমের আগ্রাসী মনোভাবে স্বপ্ন দেখিয়েছিল বসন্তের প্রথম দিন জয়ের রংয়ে রাঙানোর। কিন্তু হোম অব ক্রিকেটে বসন্ত আসেনি।

ব্যাটিং করতে নেমে ওপেনিং জুটি থেকে ৫৯ রান তোলে বাংলাদেশ। ১৩ ইনিংস পর বাংলাদেশ ওপেনিং জুটি থেকে পঞ্চাশোর্ধ্ব রান করে লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। এরপরের গল্প শুধু হতাশার। বিস্বাদে মাখা। বিপর্যয়ের শুরুটা করেছেন সৌম্য। প্রথম ইনিংসে ডাক মেরে আউটের পর এই ইনিংসেও আউট হয়েছেন দৃষ্টিকটুভাবে। কর্নওয়াল-ওয়ারিক্যান যখন উইকেটের দেখা পাচ্ছিলেন না তখন বাজিমাত করেন ব্র্যাথওয়েট। সৌম্যর আউটে মনে হয়েছে স্লিপে দাড়িয়ে থাকা কর্নওয়ালকে দেখতে পাননি। আউটগুলো ব্যাখাতীত।

সৌম্য আউটের পর দলীয় স্কোরে ১১ যোগ না হতেই আউট হন তামিম। যেন তার কোনও দায়িত্ব নেই। ব্র্যাথওয়েটের বলে অযথা শট খেলতে গিয়ে সাজঘরে ফেরেন ৪৪ বলে ফিফটি করা তামিম। তার আউটের পর মাঝে মাঝে প্রতিরোধের আভাস দিলেও আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বাংলাদেশ। কর্নওয়ালের বলে শর্ট লেগে ক্যাচ প্র্যাকটিস করে ১১ রানে সাজঘরে ফেরেন শান্ত।

চা বিরতির পর মুশফিক কর্নওয়ালের বাঁক খাওয়া বলে ক্যাচ দেন উইকেটের পেছনে। ১৪ রান করা মুশফিক সঙ্গে সঙ্গে রিভিউ নিয়ে নেন, কিন্তু কাজে আসেনি। মুশফিক আউটের পর মিথুনকে নিয়ে ইনিংস মেরামতের চেষ্টা করছিলেন মুমিনুল। কিন্তু ১৫ করা মিথুন যেভাবে আউট হয়ে সাজঘরে ফেরেন মনে হয়নি তিনি ব্যাটিং করতে এসেছেন। তিনিও সাজঘরে ফেরেন শর্ট লেগে ক্যাচ দিয়ে।

তখনও মুমিনুল ক্রিজে থাকায় স্বপ্ন ফুরিয়ে যায়নি। কিন্তু একবার শর্ট মিড উইকেটে জীবন পাওয়া অধিনায়ক ২৬ রানে ওয়ারিক্যানের বলে গালিতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন। মুমিনুল আউটের ৬ রান পরেই লিটন যখন ব্যক্তিগত ২২ রানে ফেরেন সাজঘরে তখন বাংলাদেশ শিবিরে ভর করেছে হারের শঙ্কা।

এরপর লড়াই শুরু করেন মিরাজ। নাঈমের সঙ্গে ২৫ রানের জুটি গড়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দিয়েছিলেন। দলীয় ১৮৮ রানে নাঈমের (১৪) আউটে তা শেষ হয়ে গিয়েছিল। এরপর মিরাজ একাই ১৮৮ থেকে ২১৩ রান পর্যন্ত টেনে নিয়ে আসেন। রাহীর সঙ্গে ২৫ রানের জুটিতে ২৫টি রানই ছিল তার। কিন্তু শেষটা রাঙাতে পারেননি তিনি। ফাল্গুনের প্রথম বিকেলে কোকিলের সুমিষ্ট কণ্ঠ নিশ্চয় বসন্ত বিলাপ মনে হচ্ছিল মুমিনুলদের!