খেলাধুলা

কৃষক সন্তানের টেস্ট স্বপ্নপূরণ

কৃষক বাবার সন্তান হয়ে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখা ছিল বিলাসিতা। দুইবেলা ঠিকমতো খাবারের নিশ্চয়তা যেখানে ছিল না, সেখানে বল-ব্যাট নিয়ে সময় কাটানো ছিল বড্ড বাড়াবাড়ি। কিন্তু রাত জেগে স্বপ্ন দেখা শরিফুল ইসলাম জানতেন, অভাবের সংসারে আলোর মুখ দেখাবে ক্রিকেট।

তাইতো বাবা-মাকে রাজি করিয়ে শরিফুল স্বপ্নের পেছনে ছোটা শুরু করেন। কাঁটা বিছানো পথ পেরিয়ে তিনি এখন ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদার টেস্ট ফরম্যাটে।

টেস্ট ক্যাপ অমূল্য। ক্রিকেটারদের আজন্ম আরাধ্য স্বপ্ন হয়ে থাকে একটা টেস্ট ক্যাপ। শ্রীলঙ্কার পাল্লেকেলেতে বৃহস্পতিবার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো শরিফুলের। বাংলাদেশের ৯৭তম টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে যুব বিশ্বকাপজয়ী এ পেসারের অভিষেক হলো।

জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজনের কাছ থেকে টেস্ট ক্যাপ পেলেন শরিফুল। বোলিংয়ের শুরুটাও হয়েছে দারুণ। নবম ওভারে বোলিংয়ে এসে বাঁহাতি লাহিরু থিরিমান্নেকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেন। চতুর্থ ও পঞ্চম স্টাম্প বরাবর লাইন ও লেংথ ধরে বোলিং করে প্রথম ওভারটি নিয়েছেন মেডেন। দ্বিতীয় ওভারে একই ধারাবাহিকতা। তৃতীয় ওভারের প্রথম বলে উইকেটও পেয়ে যেতেন। থিরিমান্নে তার অফস্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা মারতে গিয়েও বেঁচে যান। প্রথম ঘণ্টার বিরতির আগ পর্যন্ত নতুন বলে ধারাবাহিক তিনি। সামনে এ ধারাবাহিকতা থাকলে উইকেট পেতে সময় লাগবে না।

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নের নগরপাড়া এলাকায় শরিফুলের বাস। বাবা দুলাল মিয়া কৃজিকাজ করে দিনযাপন করতেন। দুই ভাই ও বাবা-মায়ের অভাবের সংসার। ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না। অথচ শরিফুলের দুই চোখ ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। স্বপ্নটা দেখেছিলেন আরেক বাঁহাতি পেসার মোস্তাফিজুর রহমানকে দেখে। কীভাবে?

রাইজিংবিডিকে সেই গল্প শুনিয়েছিলেন শরিফুল, ‘আমাদের বাড়িতে আমি, ভাই, মামা আর আমার বাবা-মা থাকি। আমাদের ঘর বলতে একটা টিনের আরেকটা ছনের ঘর। আমাদের বাড়িতে বিদ্যুতের কোনও সংযোগ ছিলও না। যার কারণে খেলা দেখতে হলে আমাদের এক কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে দেখতে হতো।’

তিনি বলতে থাকলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দেখতে ভাই-মামারাসহ একটা দলবল গিয়েছিলাম পাশের এলাকাতে। সে ম্যাচে মোস্তাফিজুর রহমানের অভিষেক হয়। তখন উনি অনেক হ্যাংলা-পাতলা ছিলেন। তাকে দেখে আমার মামা-ভাই বলে, মোস্তাফিজ যদি খেলতে পারে তুইও পারবি শরিফুল।’

‘তখন আসলে আমি টেপ টেনিস বলে প্রচুর খেলে বেড়াই। পড়াশোনার চেয়েও ক্রিকেটে বেশি মন আমার। তারপর মামা বাসায় আমার বাবা-মাকে রাজি করালো। তারপর অনেক কষ্ট করে আমাকে অনুশীলনে দিলো।’

পরের গল্পটা মোটামুটি সবারই জানা। বয়সভিত্তিক দলে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে বাঁহাতি পেসার নজর কাড়েন। ২০২০ সালে শরিফুল যুব বিশ্বকাপ জিতে চলে আসেন লাইমলাইটে। গত বছর বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপ এবং বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে ভালো করে সুযোগ পান জাতীয় দলের অনুশীলনে। বিদেশি কোচের সান্নিধ্যে নিজেকে তৈরি করেছেন। কিছুদিন আগে নিউ জিল্যান্ডে তার টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয়েছিল। এবার তার মাথায় উঠলো সম্মানের টেস্ট ক্যাপ।

পাল্লেকেলে টেস্টের সেরা একাদশে নাম লিখিয়ে শরিফুলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঢুকে গেছে ম্যাচ ফির ৬ লাখ টাকা। অথচ ২০১৭ সালে যেবার প্রথম পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন সেবার কি ঝামেলাই না পোহাতে হয়েছিল তাকে, ‘২০১৭ সালে যখন আমি প্রথমবার প্রিমিয়ার লিগ খেলি। সেবার আমি প্রাইম ব্যাংকে ছিলাম। খেলা শেষে সবার কাছে চেক আসছে। আমারটাও আসছে, কিন্তু আমি টাকা তুলতে পারছিলাম না। তখন আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল না। আর আমার অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে কি না, সে ভয় ছিল। কারণ আমার তখনও জাতীয় পরিচয়পত্রও ছিল না। এমনকি পাসপোর্টও করা হয়নি। জন্ম নিবন্ধন কার্ড দিয়ে আমার নামে স্টুডেন্ট অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল। তবে প্রথমবার টাকাটা আমি চেকে তুলতে পারিনি। সেই টাকাটা আমাকে হাতেই দেওয়া হয়েছিল। হাতে টাকা দিতে ঢাকা থেকে লোক এসেছিল পঞ্চগড়ে।’

জাতীয় দলে ছেলে খেলছে তাতে ভরে গেছে বাবা মায়ের বুক। আর দারিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ জিতে যাওয়ার আনন্দতেই ব্যাকুল শরিফুল। কত উইকেট পেলেন, কতটা শিরোপা জিতলেন সেই হিসেবের থেকেও বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়ে আনন্দ পান ১৯ বছর বয়সী এ ক্রিকেটার।

‘কোনও সন্তানের সামনে যদি তার বাবা-মা হাসে, তাহলে পৃথিবীতে তার চেয়ে সুখী কিন্তু আর কেউ হয় না। আলহামদুলিল্লাহ এখন যে অবস্থায় আছি, আমার বাবা-মাকে রাখতে পেরেছি, এটা ভেবে আমার অনেক ভালো লাগে। অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে আমরা দিন পার করছি। সে হিসেবে এখন আমরা অনেক ভালো আছি। দারিদ্রতা দূর করার আনন্দটাই আমার সবচেয়ে বেশি। আমি সবসময় চিন্তা করি যে, আগে কোথায় ছিলাম, এখন কোথায় এসেছি। খেলার মাধ্যমে হলেও দেশের জন্য কিছু করতে পারবো, নিজের পরিবারের জন্য ভালো কিছু করতে পারবো।’

পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা শরিফুল নিজেদের মেধা ও পরিশ্রমে স্বপ্ন সত্যি করেছেন। তার গল্পটা আরো অনেকের জন্য হতে পারে অনুপ্রেরণার।