আগামী ১১ জুন থেকে শুরু হচ্ছে ইউরোর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। ১১টি শহরের ভিন্ন ১১ ভেন্যুতে লড়াই হবে ২৪ দলের। এই মহাযজ্ঞের আগে ছয়টি গ্রুপ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী ধারাবাহিক আলোচনার প্রথম পর্ব ‘এ’ গ্রুপ নিয়ে:
গ্রুপের তিনটি দলই ফিফা র্যাংকিংয়ের শীর্ষ ২০ দলের মধ্যে রয়েছে। ইতালি সপ্তম, সুইজারল্যান্ড ১৩তম ও ১৭ নম্বরে ওয়েলস। গ্রুপের আরেক দল তুরস্ককে (২৯) ধরা হচ্ছে ডার্কহর্স হিসেবে। ‘এ’ গ্রুপকে ভাবা হচ্ছে এই এবার সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ।
যদিও ইতালি খানিকটা এগিয়ে। কারণ গ্রুপের সবগুলো ম্যাচ তারা খেলবে ঘরের মাঠে। এই গ্রুপের একমাত্র দল হিসেবে তারাই হোম ম্যাচের সুবিধা পাবে। কিন্তু রোমে তাদের কঠিন পরীক্ষা নেবে সুইজারল্যান্ড, ওয়েলস ও তুরস্ক।
ইতালি
২০১৮ সালের বিশ্বকাপে ইতালিকে উঠাতে ব্যর্থ হয়ে চাকরি হারান গিয়ান পিয়েরা ভেন্তুরা। তার স্থলাভিষিক্ত হন রবার্তো মানচিনি। তার ছোঁয়ায় বদলে গেছে দল। জয়ের হার ৭০ শতাংশ, তার যে কোনও পূর্বসূরিদের চেয়ে ঈর্ষণীয় সাফল্য। তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার মিশেলে এই ইতালি বাছাইপর্বের ১০ ম্যাচের সবগুলো জিতেছে। নিশ্চিতভাবে ‘এ’ গ্রুপের ফেভারিট তারা, কিন্তু লড়াইটা কি সত্যিই এত সহজ হবে?
সূচি: ১১ জুন, প্রতিপক্ষ তুরস্ক; ১৬ জুন, প্রতিপক্ষ সুইজারল্যান্ড; ২০ জুন, প্রতিপক্ষ ওয়েলস।
কোচ: রবার্তো মানচিনি
সম্ভাব্য ফরমেশন ও একাদশ: ৪-৩-৩; দোন্নারুম্মা, এমারসন, কিয়েল্লিনি, বোনুচ্চি, ফ্লোরেঞ্জি, লোকাতেল্লি, ভেরাত্তি, পেল্লেগ্রিনি, ইনসিগনে, বেরার্দি, ইম্মোবিলে।
ইউরো খেলেছে: ৯ বার
শেষ ইউরোতে: কোয়ার্টার ফাইনাল
সেরা সাফল্য: চ্যাম্পিয়ন (১৯৬৮)
নজর থাকবে যার দিকে: লাজিওর সিরো ইম্মোবিলে গত সিরি আ’য় ২০ গোল করে দুর্দান্ত ফর্মে। ২০১৯-২০ মৌসুমে ৩৬ গোল করে ইউরোপের শীর্ষ গোলদাতার পুরস্কার গোল্ডেন শু জেতেন। স্ট্রাইকার হলেও আক্রমণভাগের যে কোনও জায়গায় প্রতিপক্ষের জন্য বিপজ্জনক তিনি। গোলমুখের সামনে তার ফিনিশিংয়ের সামর্থ্যও চোখে পড়ার মতো। মাঝমাঠে এবার সম্ভাবনা জাগাচ্ছেন ম্যানুয়েল লোকাতেল্লি। ইতালির সুপ্ত প্রতিভা বলা হচ্ছে তাকে। এবার সিরি আ’য় খেলেছেন সাসসুওলোর সঙ্গে। জাতীয় দলের সঙ্গে প্রথম বড় টুর্নামেন্টে দারুণ ছাপ রাখতে পারেন এই ২৩ বছর বয়সী মিডফিল্ডার।
শক্তি ও দুর্বলতা: আগের মতোই দলটির সবচেয়ে বড় শক্তি রক্ষণ। মানচিনির দল তা আবারও প্রমাণ করেছে ১০টি বাছাইয়ের ম্যাচে মাত্র চার গোল খেয়ে এবং ছয় ম্যাচে ক্লিন শিট রেখে। জুভেন্টাসের লিওনার্দো বোনুচ্চি ও জর্জিও কিয়েল্লিনি এবং আতালান্তার রাফায়েল তোলোইয়ের মতো অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার আছে দলে। তাদের রক্ষণ ভাঙা প্রতিপক্ষের জন্য কঠিন হবে নিশ্চিত।
রক্ষণে দুর্দান্ত হলেও ইতালি যে গোল পায় না তা নয়। বাছাইয়ে ৩৭ গোল করেছে তারা। অভিজ্ঞ ফরোয়ার্ডরাও আছেন। কিন্তু ক্লাবের পারফরম্যান্স জাতীয় দলের জার্সিতে দেখাতে পারছেন না ইম্মোবিলে। একই অবস্থা নাপোলির লরেঞ্জো ইনসিগনে ও তুরিনোর আন্দ্রে বেলোত্তির। তাই ইতালির আক্রমণের দায়িত্ব কে নেবে, সেটাই প্রশ্ন।
সুইজারল্যান্ড
সুইজারল্যান্ডকে নিয়ে কোনও পূর্বাভাস করা কঠিন। এই দলটি নেশনস লিগের ছয় ম্যাচে টানা পাঁচটিতে জয়ের মুখ দেখেনি। পরে জিতেছে টানা ছয় ম্যাচ। লিচটেনস্টেইনকে ৭-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ইউরোতে নামছে তারা। জিতেছে ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, লিথুয়ানিয়া, ফিনল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে। শক্তি-সামর্থ্যে তারা ছিল এগিয়ে, স্বাভাবিকভাবে এসব জয় প্রত্যাশিত ছিল। ইউরোর আগে সুইশদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিচ্ছে খেলোয়াড়দের প্রস্তুতির ঘাটতি। ফ্যাবিয়ান শুহার ইনজুরিতে মৌসুমের বেশির ভাগ সময় ছিলেন মাঠের বাইরে। জেরদান শাকিরিকেও খুব একটা দেখা যায়নি লিভারপুলের জার্সিতে।
কোচ: ভ্লাদিমির পেতকোভিচ
সম্ভাব্য ফরমেশন ও একাদশ: ৩-৪-৩; সোমার, এলভেদি, আকানজি, রোদ্রিগেজ, ভিদমার, ফ্রুয়েলার, জাকা, ভার্গাস, শাকিরি, সেফেরোভিচ, এমবোলো।
সূচি: ১২ জুন, প্রতিপক্ষ ওয়েলস; ১৬ জুন, প্রতিপক্ষ ইতালি; ২০ জুন, প্রতিপক্ষ তুরস্ক।
ইউরো খেলেছে: ৪ বার
শেষ ইউরোতে: শেষ ষোলো।
সেরা সাফল্য: শেষ ষোলো (২০১৬)।
নজরে থাকবেন: সামঞ্জস্যতা, স্থিতিশীলতা ও শক্তির মিশেলে সুইশ মাঝমাঠকে দারুণভাবে সামাল দেওয়ার ক্ষমতা আছে গ্রানিত জাকার। কৌশলগত প্রতিভা এবং একজন অভিজ্ঞ নেতা, দলের তরুণ খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত করার দায়িত্ব থাকবে তার ওপর। এছাড়া আছেন অভিজ্ঞ জেরদান শাকিরি।
শক্তি ও দুর্বলতা: ফল বের করে আনতে পারার দারুণ সামর্থ্য আছে সুইজারল্যান্ডের। বাছাইয়ে সর্ববিজয়ী রূপে দেখা যায়নি পেতকোভিচের দলকে। কিন্তু শাকিরিকে ছাড়াও বাছাইয়ে ডেনমার্ক ও আয়ারল্যান্ডের মতো দলের গ্রুপের শীর্ষে থাকা বাড়তি আত্মবিশ্বাস দেবে তাদের।
সুইশ বেঞ্চে সামর্থ্যবান খেলোয়াড় নেই বললেই চলে। বদলি নেমে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারা খেলোয়াড় খুব কম তাদের। গত ইউরো ও বিশ্বকাপে শেষ ষোলোতে বিদায় নেওয়া সুইজারল্যান্ড এবার পরের ধাপে পা ফেলতে পারে কি না দেখার অপেক্ষা।
ওয়েলস
২০১৬ সালে ক্রিস কোলম্যানের দলের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি এবার করা হয়তো অসম্ভব। যদিও ফ্রান্সে গেলো আসরের মূল খেলোয়াড়রা এখনও দলে আছেন, তাদের সঙ্গে উদীয়মান প্রতিভা নিজেদের বিকশিত করতে তৈরি। ড্যানিয়েল জেমস, নেকো উইলিয়ামস ও ইথান আম্পাডুর সঙ্গে বেল ভালো কিছুর সম্ভাবনা জাগাচ্ছেন।
কোচ: রব পেজ
সম্ভাব্য ফরমেশন ও একাদশ: ৩-৪-৩; ওয়্যার্ড, রোডোন, লরেন্স, মেম্ফাম, উইলিয়ামস, আম্পাডু, অ্যালেন, রবার্টস, বেল, জেমস, উইলসন।
সূচি: ১২ জুন, প্রতিপক্ষ সুইজারল্যান্ড, ১৬ জুন, প্রতিপক্ষ তুরস্ক, ২০ জুন, প্রতিপক্ষ ইতালি।
ইউরো খেলেছে: ১ বার
শেষ ইউরোতে: সেমিফাইনাল
সেরা সাফল্য: সেমিফাইনাল (২০১৬)
নজরে থাকবেন: গ্যারেথ বেল। ওয়েলসের অন্যতম অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে উঠেছে ৩৩ বার। দলের আক্রমণভাগের সবচেয়ে নির্ভরতার প্রতীক তিনি। টটেনহ্যাম হটস্পারে এই মৌসুমটা কেটেছে গড়পড়তা পারফরম্যান্সে। তবে এখনও যে দেওয়ার মতো অনেক কিছু আছে, সেটাই প্রমাণ করতে চাইবেন ইউরোর মঞ্চে।
শক্তি ও দুর্বলতা: তরুণ ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর দল। তাতে করে কাউন্টার অ্যাটাকে প্রতিপক্ষকে ভড়কে দিতে পারেন। দলের মধ্যে ভয়ডরহীন মনোভাবও তাদের এগিয়ে রাখছে।
ফর্মের শীর্ষে নেই বেল ও অ্যারন রামজির মতো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়রা। ক্লাব পর্যায়ে দুজনই ছিলেন নিষ্প্রভ। তারা জ্বলে উঠতে না পারলে খারাপ সময় যেতে পারে ওয়েলসের।
তুরস্ক
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে বাছাইপর্বে হারানোর স্মৃতি এখনও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। অল্পের জন্য টেবিলের শীর্ষে ওঠা হয়নি। আক্রমণভাগের আস্থাভাজন খেলোয়াড় বুরাক ইলমাজের সঙ্গে সিলিক ও সোয়ুনকুর রক্ষণভাগ ছিল অসাধারণ। রক্ষণ ও আক্রমণভাগ দিয়েই প্রতিপক্ষের কঠিন পরীক্ষা নেবে তুর্কিরা।
কোচ: সেনোল গুনেস
সম্ভাব্য ফরমেশন ও একাদশ: ৪-৫-১; কাকির, মেরাস, সোয়ুনকু, কাবাক, সিলিক, ইয়োকুসলু, তুফান, কালহানোগলু, আন্তালিয়ালি, উন্ডার, তোসুন।
সূচি: ১১ জুন, প্রতিপক্ষ ইতালি; ১৬ জুন, প্রতিপক্ষ ওয়েলস; ২০ জুন; প্রতিপক্ষ সুইজারল্যান্ড।
ইউরো খেলেছে: ৪ বার
শেষ ইউরোতে: গ্রুপ পর্ব।
সেরা সাফল্য: সেমিফাইনাল (২০০৮)।
নজরে থাকবেন: লিঁলের হয়ে এই মৌসুমে ২৭ ম্যাচ খেলে মুগ্ধ করেছেন জেকি সিলিক। ক্লাবকে লিগ ওয়ান জেতাতে তিন গোল করেছেন, বানিয়ে দেন দুটি। পারফরম্যান্স দিয়ে ম্যানইউ, আর্সেনাল ও টটেনহ্যামের মতো প্রিমিয়ার লিগ ক্লাবের নজর কেড়েছেন তিনি।
ইউরোর বাছাইয়ে গোল করাতে না পারলেও ২৪ বছর বয়সীকে আধুনিক যুগের ফুলব্যাক বলা হয় তাকে। আটবার একাদশে থেকে খেলেছেন, ডান প্রান্ত সামাল দিয়েছেন দারুণ দক্ষতায়।
শক্তি ও দুর্বলতা: মাত্র তিনবার তাদের জালে বল জড়াতে পেরেছে প্রতিপক্ষ, তাতে ইউরো বাছাইয়ের সেরা রক্ষণের রেকর্ড তুরস্কের দখলে। ১০ ম্যাচে আটবার ক্লিনশিট, রয়েছে ফ্রান্সের বিপক্ষে ঘরের মাঠে দুর্দান্ত জয়ের অভিজ্ঞতা। প্রতিপক্ষকে গোল পেতে অনেক ঘামই ঝরাতে হবে।
তুরস্কের গোলকিপিং সামর্থ্য আশা জাগানিয়া নয়। একাদশের সম্ভাব্য গোলকিপার উগুরান কাকির অনভিজ্ঞ, ক্লাব পর্যায়েও তেমন অভিজ্ঞতা নেই তার। রক্ষণ ভেঙে গেলে শেষ মুহূর্তে ভুগতে হতে পারে তুর্কিদের।