খেলাধুলা

হাশিম আমলার ব্লকাথন: ২৭৮ বলে ৩৭ রানের অনিন্দ্য সুন্দর মহাকাব্য

আপনি চাইলেই রান করতে পারেন। সাদা পোশাকে একদিনে কত রান করতে চান? ৩০৯, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। করেছিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। চাইলে আপনি তার রেকর্ড ভাঙতেই পারেন। কিন্তু আপনি কী এতটা স্থির হবেন যে, সারাদিন ব্যাটিং করবেন কিন্তু রানের ক্ষুধা থাকবে না!

ধরে নিন লোভনীয় হাফ ভলি পেলেন। কিন্তু ড্রাইভ করবেন না। আপনি জানেন নিখুঁত টাইমিংয়ে বল চলে যাবে বাউন্ডারিতে। তবুও ড্রাইভ করবেন না। এতটা ধৈর্য কি দেখাতে পারবেন? যদি দেখাতে পারেন তাহলে আপনি হতে পারেন ‘হাশিম আমলা’।

ক্রিকেটে ব্র্যান্ড তৈরি হতে লাগে বছরের পর বছর। এজন্য অক্লান্ত পরিশ্রম, কষ্ট, সাধনা, ত্যাগ করতে হয়। হাশিম আমলা ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সেই ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন। আর তার সেই ব্র্যান্ডের আদুরে নাম ‘হাশিম আমলার ব্লকাথন’।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার ব্যাটে ছিল রানের ফোয়ারা। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯২৮২ রান নিয়ে গিয়েছেন অবসরে। জাতীয় দলের জার্সি খুলে রাখলেও কাউন্টিতে ডানহাতি ব্যাটসম্যান খেলছেন নিয়মিত। বয়স ৩৮ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তার পারফরম্যান্সে একটুও ছন্দপতন নেই।

বুধবার রাতে সেই প্রমাণই দিলেন আমলা। তার ব্যাট থেকে আসা আরেকটি ‘হাশিম আমলার ব্লকাথন’। স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কীভাবে সাঁতার কাটতে হয়, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কীভাবে বুক চিতিয়ে লড়াই করতে হয়, সাধ্যের বাইরে গিয়ে কীভাবে নিবেদন দেখাতে হয় তার সবটুকু আমলা দেখিয়ে দিয়েছেন সারের জার্সিতে, কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে।

সাউদাম্পটনে হ্যাম্পশায়ারের মুখোমুখি সারে। আগে ব্যাটিং করে হ্যাম্পশায়ার ৪৮৮ রান তুলে নেয়। জবাবে সারের প্রথম ইনিংস থেমে যায় ৭২ রানে। ফলো অনে পড়া দলকে উদ্ধারে লাগলেন আমলা। শুধু উদ্ধারই নয়, শেষ দিনে ম্যাচ বাঁচাতে হলে দেয়াল হতে হবে তাকে। ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল বৃষ্টির কারণে খেলা নষ্ট হওয়ায় শেষ দিন ৯৮ ওভার খেলা হবে। 

চারে ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন তিনি। চতুর্থ বলে খুলেছিলেন রানের খাতা। এরপর যা হলো তা রীতিমত অবিশ্বাস্য। দ্বিতীয় রানের জন্য ডানহাতি ব্যাটসম্যান খেলেন ৬৩ বল। তার লড়াইয়ে স্পষ্ট বার্তা ছিল, যত কিছুই হোক তিনি আজ রান করবেন না। ঠিক সেভাবেই এগোলেন। তার ব্যাট থেকে প্রথম বাউন্ডারি আসে ১২৬ বলে। এরপর আরও চারটি মেরেছে লম্বা বিরতিতে। 

২২ গজে হার না মানা মনোবল, চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, দৃঢ়চেতা মনোভাব ও অদম্য ইচ্ছা শক্তিতে আমলা হয়ে উঠেন দেয়াল। যাকে কেউ ভাঙতে পারেনি, টলাতে পারেনি। রান না তোলার এমন উদাহরণ তো এর আগেও করেছেন তিনি।

ভারতের বিপক্ষে দিল্লিতে ২৪৪ বলে করেছিলেন ২৫ রান। ভারতেই বিপক্ষেই আরেক টেস্টে করেছিলেন ১৫৯ বলে ২৫। দুইবারই আমলা দলের পরাজয় এড়াতে পারেননি। তবে এবার সারের নায়ক তিনি। তার অতিমানবীয় ইনিংস ছিল ২৭৮ বলের। যেখানে তিনি রান করেছেন মাত্র ৩৭। আর উইকেটে থিতু হয়ে ছিলেন ৩৮১ মিনিট। এমন অনিন্দ্য সুন্দর মহাকা্য ক্রিকেট কী এর আগে দেখেছিল?

উত্তর, না দেখেনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ইতিহাসে ৪০ রানের কম ইনিংসে সবচেয়ে বেশি বল খেলার রেকর্ড এটিই। ১৯৫৩ সালে ট্রেভর বেইলি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৭৭ বলে করেছিলেন ৩৮ রান। আরেকটি পরিসংখ্যান আমলার কীর্তিকে আরও নিখুঁত করে তুলবে। শেষ ১৫ বছরে আমলার ব্যাটিং স্ট্রাইক রেট ছিল দ্বিতীয় সর্বনিম্ন, ১৩.৩০। রাজশাহীর নাঈম ইসলাম জুনিয়র জাতীয় লিগে ২০১৫ সালে ৩২৮ বলে করেছিলেন ৬৩ রান।

রান তুলতে আমলা কোনও তাড়াই দেখাননি। তার চতুর্থ উইকেটের সঙ্গীও সমান তালে এগিয়েছেন। দুজন ১৭৩ বলে মাত্র ২১ রান জমা করেছেন। যা ধীরগতির জুটির রানে চতুর্থ সর্বনিম্ন।

তার ইনিংসের ব্যবচ্ছেদ করলে আরও দেখা যায়, ১০০ বলে করেছেন মাত্র ৩ রান। ১৫০ বলে ১৮, ২০০ বলে ২৬ ও ২৫০ বলে ৩৭। দিনের খেলা শেষ হয় ১ বল আগে। এর আগে ২৮ বল খেলে কোনও রান নেননি কিংবদন্তি ক্রিকেটার। তাতে ম্যাচ বেঁচে যায় সারের। আর নায়ক হয়ে যান আমলা।

তিনি বাদে চেষ্টা করেছেন মধ্যভাগের ব্যাটসম্যানরাও। রায়ান পাটেল ৮৬ বলে ১৬, জেমি স্মিথ ৬০ বলে ১৪, বেন গেডেজ ৫৪ বলে ১৫। তাদের ফিরিয়ে হ্যাম্পশায়ারের বোলাররা ম্যাচ জমিয়ে তুললেও আমলাকে ফেরানোর উত্তরটা তাদের জানা ছিল না। তাইতো সাউদাম্পটনে লেখা হলো, ২৭৮ বলে ৩৭ রান ও ৩৮১ মিনিটের অনিন্দ্য সুন্দর মহাকাব্য। যে মহাকাব্যের নাম, ‘হাশিম আমলার ব্লকাথন’।