খেলাধুলা

ন্যাপকিন পেপারে লেখা ইতিহাসের এমন সমাপ্তি!

একটি ন্যাপকিন পেপার, তা কি কখনও মূল্যবান হতে পারে? সোজাসাপ্টা উত্তর- কখনোই না। কিন্তু যারা ফুটবলের খোঁজখবর রাখেন, তাদের অজানা নয় যে একটি মূল্যহীন ন্যাপকিন পেপারও হয়ে উঠতে পারে রূপকথার ধারক, একটি অনন্য দলিল এবং একটি ইতিহাসের সূচনা। যে দলিল অমূল্য হিসেবে সংরক্ষিত থাকলেও সমাপ্তি হলো সেই ইতিহাসের।

এই ইতিহাসের সূচনা করেছিলেন আর্জেন্টিনার কম দৈহিক উচ্চতার এক বালক। যিনি গ্রোথ হরমোনের সমস্যায় ভুগছিলেন। কিন্তু ফুটবল নিয়ে তার পায়ের কারুকাজ ছিল বিস্ময় করার মতো। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে সেই ১৩ বছরের বালক পরিবারের সঙ্গে যায় বার্সেলোনায়। ট্রায়ালে সবাইকে চমকে দেন। ক্লাবটি চুক্তি করবে সেই আশা নিয়ে রোজারিওতে ফিরে যান বাবা-মা। কিন্তু কাতালান ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি হুয়ান গাসপোর্ত সংশয়ে ছিলেন। তা পাত্তা না দিয়ে হোরাশিও গাগিওলি নামের এক ব্যক্তি তাকে বলে দিলেন, এখনই নিতে হবে তাকে নয়তো পস্তাতে হবে!

ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর বার্সার টেকনিক্যাল সেক্রেটারি কার্লোস রেক্সাসের সঙ্গে একটি ক্লাবে টেনিস খেলছিলেন গ্যাগিওলি। খেলা শেষে তারা ঢোকেন রেস্তোরাঁয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেন খেলোয়াড়দের এজেন্ট হোসে মারিয়া মিনগুয়েলা। রেক্সাসকে গ্যাগিওলি আর তিনি মিলে চেপে ধরলেন ওই বালকটির সঙ্গে চুক্তি করানোর জন্য। আর পেরে উঠলেন না রেক্সাস। নাছোড়বান্দা দুজনকে থামাতে হাতের কাছে থাকা একটি ন্যাপকিন পেপার নিয়ে তাতে তিনি লিখলেন, ‘২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর মিনগুয়েলা, হোরাশিও ও বার্সার টেকনিক্যাল সেক্রেটারি কার্লোস রেক্সাসের উপস্থিতিতে পূর্ণ দায়িত্বের সঙ্গে কিছু ব্যাপারে অমত থাকলেও একটি নির্দিষ্ট অঙ্কে লিওনেল মিসকে সই করানোর ব্যাপারে একমত হওয়া গেল।’ নিচে তাদের তিনজনের স্বাক্ষর। যাকে ঘিরে এই কয়েক মাসের উত্তেজনা, তিনি আর কেউ নন- লিওনেল মেসি। কয়েক সপ্তাহ পর ওই ন্যাপকিনকে নোটারির মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়ার কাজ করেন রেক্সাস।

এখানেই শেষ নয়, মেসির চিকিৎসার সব ব্যয়ভার নিয়ে নিল বার্সা। এটা জনাতে পেরে বেশি দেরি করেননি বালক মেসি ও তার বাবা। পাড়ি জমান বার্সায়। যুব একাডেমি লা মাসিয়াতে যোগ দিয়ে শুরু হয় তার খেলোয়াড়ি জীবন। আর পেছন ফিরতে হয়নি। ২০০৪ সালের অক্টোবরে বার্সার মূল দলে অভিষেক, বয়স ১৭ বছর ১১৪ দিন। এস্পানিওলের বিপক্ষে ওই যে শুরু হলো, পায়ের জাদুতে মুগ্ধ করে গেছেন সবসময়। আর ন্যু ক্যাম্পকে পরিণত করেছিলেন নিজের জন্মভূমিতে। আর সেই ন্যাপকিন পেপার হয়ে উঠেছিল অমূল্য সম্পদে, যার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিল অনেকে। কিন্তু গ্যাগিওলি তা রেখে দেন নিজ দেশ অ্যান্ডোরার একটি ব্যাংক ভল্টে। এখনো তা সেখানেই সংরক্ষিত আছে। কিন্তু দুই দশকেরও বেশি সময় পর সম্পর্ক ছিন্ন হলো মেসির সঙ্গে বার্সার।

যে ক্লাবের কাছে নতুন জীবন পেয়েছিলেন, সেই ক্লাবকে কতশত সাফল্য এনে দিয়েছেন তা গুনতে গেলে হাঁপিয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। যখন মূল দলে নাম লেখান, তখন কাতালান ক্লাবের দখলে একটি ইউরোপিয়ান কাপ, ১৬ লা লিগা ও ২৪ কোপা দেল রে ট্রফি। মেসি যুগ শেষ, সব মিলিয়ে বার্সার ট্রফি কেসে শোভা পাচ্ছে পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, ২৬টি লা লিগা ও ৩০টি কোপা দেল রে! এই সংখ্যাগুলো ক্লাবে মেসির গুরুত্ব স্পষ্ট করে দেয়। তাকে নিয়ে বার্সা সেরা সময়গুলো কাটিয়েছে। এটা সত্যি যে, অনেক মৌসুমে তার চারপাশে ছিলেন বড় বড় খেলোয়াড়রা। কিন্তু রোজারিওতে জন্ম নেওয়া ১০ নম্বর জার্সিধারী ছিলেন সবসময় প্রাণকেন্দ্রে। ক্লাবের হয়ে সর্বকালের শীর্ষ গোলদাতা, সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড মেসির পায়ে লুটিয়ে পড়েছে। জিতেছেন ছয়টি ব্যালন ডি’র। রেকর্ড ছয়টি ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু। সমান সংখ্যক বার লা লিগার সেরা খেলোয়াড়। কিছুই পাওয়ার বাকি ছিল না তার, এমনকি দেওয়ারও।

৭৭৮ ম্যাচ, ৬৭২ গোল, ৩০৫ অ্যাসিস্টে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। তবে গত মৌসুম শুরু না হতেই আকস্মিকভাবে ব্যুরোফ্যাক্সে বার্সা ছাড়ার ঘোষণা দেন অভিমানী মেসি। পারেননি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসেপ মারিয়া বার্তোমেউর কুটবুদ্ধির কারণে। রিলিজ ক্লস জটিলতায় সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হয়। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, সেই অভিমান থেকে সরে আসেন মেসি। সব মিলিয়ে গত মৌসুমে ৪৭ ম্যাচে ৩৮ গোল করে বুঝিয়ে দেন, এখনো অন্তরে রয়েছে বার্সার প্রতি ভালোবাসা। একই সঙ্গে শেষ হতে বসেছিল তার চুক্তির মেয়াদ। তাকে রেখে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন জিতে হোয়ান লাপোর্তার প্রেসিডেন্সি শুরু হয়। সব চেষ্টাই তিনি করে গেছেন প্রতিশ্রুতি রক্ষায়। এমনকি মেসি যখন কাগজে কলমে আর বার্সার নয়, তখনও। কিন্তু আর্থিক সংকট আর লা লিগার কঠোর নীতিতে হার মানতে বাধ্য হলেন। ঘোষণা দিলেন মেসিকে তারা আর রাখতে পারছেন না। কারণ তাকে চুক্তি করলে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বার্সা। 

তারপরও এমন ঘোষণার অপেক্ষায় কোনোকালে ছিলেন না বার্সা কিংবা মেসি ভক্তরা। তাকে শেষ বিদায়টাও জানানো হলো না। হতভম্ব করা এই ঘোষণার পর সকাল থেকে ন্যু ক্যাম্পের গেটে শতশত ভক্ত দাঁড়িয়ে ছিলেন। ‘ওয়ান ক্লাব ম্যান’ জাভি হার্নান্দেজ ও কার্লোস পুয়োলের মতো একটা বিদায় সংবর্ধনা পাওয়ার দাবি তো রাখেন আর্জেন্টাইন মহাতারকা। লাপোর্তা করলেন দুঃখ প্রকাশ, করোনাভাইরাস বিধিনিষেধের কারণে তা সম্ভবত নয়। ন্যাপকিন পেপারে লেখা ইতিহাসের এমন সমাপ্তি কে-ই বা দেখতে চেয়েছিল!