খেলাধুলা

আজও তিনি আস্থার ছায়া

আমি মূলত বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাসায় যেতাম বল আনতে। ক্রিকেট বল! ’৭৩/৭৪ সালের দিকে ক্রিকেট বলের ক্রাইসিস ছিল। শেখ কামাল ভারত থেকে ক্রিকেট বল নিয়ে আসতো। আমরা সেই বল বিভিন্ন ক্লাবের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতাম। শুধু আবাহনী খেললে তো হবে না। ক্রিকেটে আরো দলকে খেলতে হবে। বিভিন্ন ক্লাব তখন তিনটা/চারটা করে ক্রিকেট বল কোটায় পেত। আমরা তখন ক্রিকেট বলের অনেক যত্ন নিতাম। খেলতে খেলতে প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া ক্রিকেট বলও সযত্নে রাখতাম, পরদিন খেলার জন্য।

এভাবেই বঙ্গবন্ধুর বাসায় আমার যাওয়া-আসা। ৩২ নম্বরের সেই বাড়িজুড়ে চিরায়ত বাঙালির ছাপ। যিনি দেশের স্বাধীনতা এনে দিলেন, যিনি দেশের অবিসংবাদিত নেতা, যার এক ডাকে দেশের মানুষ এক মিছিলের কাতারে চলে আসতো, অথচ তিনি কী সাধারণ জীবন-যাপন করেন!

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ফুটবল মাঠে। ফুটবলার হিসেবে। আমি তখন নিয়মিত ফুটবল খেলতাম। আজকের যেটা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, সেখানে স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশ একাদশের মধ্যে একটা প্রীতি ফুটবল ম্যাচ হয়। ’৭২ সালে সেই ম্যাচের আগে বঙ্গবন্ধু ফুটবলারদের সঙ্গে পরিচিত হন। ওই ফুটবল ম্যাচে দেশের সেরা ফুটবলারদের সঙ্গে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরাও অংশ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিজেও ফুটবল খেলতেন। সেদিন মাঠে খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বঙ্গবন্ধু সেই গল্পও করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু আসলে সব ক্ষেত্রেই অনন্য উদাহরণ। স্বমহিমায় নিজেকে তৈরি করা অবিস্মরণীয় এক ব্যক্তিত্ব। ’৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে আবাহনী আইএফএ শিল্ডে খেলার আমন্ত্রণ পায়। কলকাতার মাঠের এই টুর্নামেন্ট তখনকার দিনের অনেক মর্যাদাপূর্ণ খেলার আসর ছিল। আবাহনী লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং আমন্ত্রিত দল হিসেবে ফুটবল দল কলকাতা যাচ্ছে আইএফএ শিল্ডে খেলতে- এই দুই উপলক্ষ সামনে রেখে আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। শেখ কামাল সেই সফরে দলের হেড অব ডেলিগেট। গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের সেই স্মৃতি আজো আমার চোখে ভাসে। আমার মনে আছে, বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন-তোমরা খেলার মাঠে নতুন একটা দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছো। মাঠের খেলায় জিততে হবে, মানুষের মনও জিততে হবে। দেশের সম্মান বাড়াতে হবে।

যিনি দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। সেই তাঁর কাঁধেই দায়িত্ব দেশ পুর্ণগঠনের। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটা দেশ তো তখন সবদিক থেকে পিছিয়ে। পাকিস্তানিদের বোমা, গ্রেনেড হামলায় দেশের সব রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট ভাঙ্গা। আর্থিক সঙ্গতিও তেমন নেই। বলা যায় শূন্য থেকে তাকে দেশগঠনের কাজ শুরু করতে হয়েছিল। সেই সময়েও বঙ্গবন্ধু দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি তার সূক্ষ্ম দৃষ্টি রেখেছিলেন। ফুটবল-ক্রিকেটসহ সব ধরনের খেলার প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল। কখনো কোনো লোক তার কাছ থেকে বিমুখ হয়ে ফিরেছে-অন্তত আমি এমনটা দেখেনি। কারো সঙ্গে প্রথমবার দেখা হলেও তিনি তাকে পরম মিত্রের মতো আপন করে নিয়েছেন। আমরা সেসময় যারা ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে জড়িত ছিল তারা তো তাঁর অপত্য স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকালেই মনে হতো মাথার ওপর আস্থার ছায়া হয়ে আছেন তিনি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে দেখামাত্র আমার কাছে সবসময় মনে হতো এই মানুষটা আমার নির্ভরতার মানুষ। তার কাছে আশ্রয় মিলবেই। ভীষণ উদারমনা ব্যক্তিত্ব ছিল বঙ্গবন্ধুর। তাঁর কাছে কখনো কেউ কোনো কিছু চেয়ে মন খারাপ করে ফিরেছে এমন ঘটনা নেই। চাওয়ার মতো করে চাইলে তিনি কখনোই ফেরাতেন না।

মানুষকে ক্ষমা করার আকাশসম উদারতা ছিল তাঁর। আমার কাছে মনে হতো এই মানুষটার কাছে গিয়ে যদি বলি- ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দিন। তাহলে অবশ্যই ক্ষমা পেয়ে যাবো। তাঁর চোখে আমি সেই ভালোবাসা দেখেছি। সেই আশ্রয় দেখেছিলাম। এমন একটা আশ্রয় আমরা অকালেই হারিয়ে ফেলেছি।

কত হবে তখন আমার বয়স? ২৩ বা ২৪। ওই তরুণ বয়সে আমি যে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম সেই মানুষটার ক্ষমাশীলতার অনন্য মুখচ্ছবি আজ আমার ৭২ বছর বয়সেও আমি পরিষ্কার দেখতে পাই! আসলে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে যে এসেছে সে তাঁকে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। এমনই তাঁর বিশালত্ব। এমনই এক মহীরুহ তিনি।

স্বাধীনতার পরপর সেই সময় আমাদের খেলাধুলার সাফল্যে আমরা বঙ্গবন্ধুর অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু জানতেন, তরুণদের স্পোর্টস অঙ্গনে রাখতে পারলে জাতি গঠনে সেটা দারুণ কার্যকর একটা উপায় হবে। সেই সময়ের তরুণ ক্রীড়া সংগঠক শেখ কামালকে পেয়ে সত্যিই আমরা উজ্জ্বীবিত হয়েছিলাম।

ক্রীড়াঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি ছিলো বলেই তিনি সেই সময়ের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রফেসর ইউসুফ আলীকে। মোজাফফর হোসেন পল্টু ভাইও ছিলেন ক্রিকেটের বড় দায়িত্বে। তারা শুরুটা করেছিলেন বলেই আজ দেশের ক্রিকেট বিশ্ব পরিমণ্ডলে আমাদের জন্য বড় গর্বের অংশ। 

মানুষকে অনুপ্রাণিত করার দুর্দান্ত ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর। কথায়-আচরণে-কর্মে তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারতেন জাতির জনক। মানুষের ভেতরের শক্তি জাগিয়ে তুলতে পারতেন, এমনই ক্যারিশমা ছিল তাঁর। আমরা খেলোয়াড়রা যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি, তিনি বলতেন, কেউ চিরকাল থাকে না। তোরাই দেশের সম্পদ। তোরাই ভবিষ্যৎ। মানুষ হতে হবে। দেশের সোনার মানুষ। তাহলেই বাংলাদেশ হবে সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু নিজে ছিলেন সোনার মানুষ। স্বপ্নও দেখতেন সোনার বাংলা গড়ার। কোনো সন্দেহ নেই বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে এত দিনে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা হতো। মানুষের মনের এবং ধর্মের বিভেদ দূর করার জন্য তিনি সেই শুরুর সময়ে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করেছিলেন।

বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। হয়তো আরো অনেক এগিয়ে যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা কি আর আমরা পাবো? আমার উত্তর হলো- না। 

লেখক: জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার