খেলাধুলা

ক্রিকেটে ‘অভিমান ইনিংস’!

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলছে বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে দল ভীষণ বিপদে। ১৩২ রানে নেই ৬ উইকেট। হাল ধরলেন টেস্ট দলে হঠাৎ করে জায়গা পাওয়া মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। করলেন সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ার সেরা ১৫০ রান। তার সেঞ্চুরিই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু সেই সেঞ্চুরি উদযাপনের চেয়ে আরও বড় খবর দিলেন মাহমুদউল্লাহ। ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের জানিয়ে দিলেন আর টেস্ট খেলবো না। এটাই শেষ। পরদিন মাঠে নামার আগে সতীর্থরা তার জন্য ফুলের মালাও নিয়ে এলেন। বিদায় পর্ব সারলেন।

জিম্বাবুয়ের হারারেতে মাহমুদউল্লাহ’র বিদায় পর্ব চলছে। আর ঢাকায় ক্রিকেট বোর্ড কিছুই জানে না!

-তো প্রশ্ন হলো হঠাৎ করেই মাহমুদউল্লাহ টেস্ট দল থেকে কেন স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে ফেললেন। তাও আবার ক্যারিয়ার সেরা স্কোর গড়ার পর। তিনি তো এখনো যথেস্ট ফিট। ওয়ানডে খেলছেন। টি- টোয়েন্টি দলের অধিনায়কও তিনি।

উত্তর মিলল- মূলত অভিমান থেকেই মাহমুদউল্লাহর এই সিদ্ধান্ত। ১৬ মাস ধরে তিনি টেস্ট দলে ছিলেন না। জিম্বাবুয়ে সিরিজেও টেস্ট দলে তার নাম ছিল না শুরুতে। কিন্তু দলের দুই শীর্ষ ব্যাটসম্যান ইনজুরিতে তাই ব্যাকআপ হিসেবে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে দলে নেওয়া হলো। আর ব্যাকআপ খেলোয়াড় হিসেবে সফরে গিয়ে তিনিই টেস্ট দলের ‘ব্যাকবোন’ হয়ে গেলেন।

ভালো কথা। একেই তো বলে ঘুরে দাঁড়ানো। লম্বা সময় টেস্ট দল থেকে বাদ পড়ে আবার সুযোগ পাওয়ার পর ম্যাচে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন। কিন্তু সেই ফিরে আসার সময়েই আবার গুডবাই কেন?

উত্তর সেই একটাই- মাঝের ৫ টেস্ট ও ১৬ মাস তাকে টেস্ট দলে না রাখা এবং এই সময়ে তাকে টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে আর না ভাবার টিম ম্যানেজমেন্টের চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে একটা শোধ তুলতে চাইলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।

যেন জানিয়ে দিলেন, দেখো আমি এখনো সেঞ্চুরি করতে পারি! এখন নিশ্চয়ই তোমরা আমাকে ডাকবে। টেস্ট দলে রাখবে। কিন্তু আমি নিজেই চলে গেলাম। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এমনতর সিদ্ধান্ত জানিয়ে জিতলেন নাকি হারলেন- সেই রহস্য রয়েই গেল।

তবে পুরো বিষয়টা গোস্বা করে রাতে ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার মতোই অভিমান যেন!

রান্না করা ভাত রয়ে গেল, আবার পেটের ক্ষিদেও মিটল না!

এবার তামিম ইকবাল পর্ব।

টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল ঠিক করার প্রাক বৈঠক চলছে। তামিম ইকবাল গেল বছর মার্চ থেকে টি- টোয়েন্টি খেলছেন না। কখনো ইনজুরির কারণে। কখনো বা বিশ্রাম নিচ্ছেন। মাঝের চারটি টি- টোয়েন্টি সিরিজ তাকে ছাড়াই খেলেছে দল। কিন্তু দলের নিউক্লিয়াস খেলোয়াড় হিসেবে তামিম তো একাদশে অটো চয়েস। ঘোষণাটা স্বয়ং ক্রিকেট বোর্ড সভাপতিই দিয়েছেন। তাই বিশ্বকাপের দলে তাকে রেখেই অন্য নামগুলো ঠিক হচ্ছে। এখানেই ভিন্নমত দিলেন কোচ রাসেল ডমিঙ্গো। তার যুক্তি-লম্বা সময় ধরে যে দলেই নেই, তাকে ফেরাতে হলে তরুণ একজনকে সরে যেতে হবে। সেই তরুণ, যাকে নিয়ে সামনের সময়ের জন্য ভাবছে বাংলাদেশ।

কোচের এমন চিন্তার পর বৈঠকে উপস্থিত কেউ পাল্টা কোন যুক্তি দেননি। অর্থাৎ কোন কর্ণার থেকেই তামিমের বাক্সে ‘ভোট’ পড়েনি। একটু জানিয়ে দেই, সেই বৈঠকে নির্বাচকদের সঙ্গে টি- টোয়েন্টির অধিনায়কও উপস্থিত ছিলেন। সেই বৈঠকের পুরো বিবরণী তামিমের কাছে পৌছে যায়। টিম ম্যানেজমেন্টেরই যখন সমর্থন নেই, তখন দলে থাকার জন্য শ্লোগান তুলে লাভ কি? তামিম নিজের সিদ্ধান্ত বোর্ডের শীর্ষকর্তাকে জানিয়ে দেন। খানিকবাদে নিজের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে বলে দিলেন-‘আমি এবারের টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপে না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

বিশ্বকাপ থেকে তামিমের এই সরে আসার পেছনে ক্রিকেটীয় যুক্তি অবশ্যই আছে। তবে সব ছাপিয়ে এখানেও আবেগ আর অভিমানের ছড়াছড়িই যে একটু বেশি!

কোচ-অধিনায়ক-নির্বাচক কারোর যখন সমর্থন নেই তখন অটোচয়েজ হয়ে লাভ কি? তাই তামিম সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন,এবারের বিশ্বকাপ বরং আমি টিভিতে দেখি!

এবং মুশফিকুর রহিম।

নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সিরিজ শুরুর আগে কোচ রাসেল ডমিঙ্গো জানালেন, এই সিরিজে উইকেটকিপিং নুরুল হাসান সোহান ও মুশফিক রহিমের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। প্রথম দুই ম্যাচে সোহান কিপার। পরের দুটিতে মুশফিক। যার পারফরমেন্স ভাল হবে তিনি কিপিং গ্লাভস পাবেন শেষ এবং পঞ্চম ম্যাচে। মুলত সেই বিবেচনায় ঠিক হবে টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কিপিং করবেন কে?

১৬ বছর ধরে আর্ন্তজাতিক ক্রিকেট খেলার পর এখন ক্যারিয়ারের শেষভাগে কিপিং গ্লাভস নিয়ে এই ভাগাভাগি করা বা নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করাটা মুশফিকের মর্যাদায় লাগল। দ্বিতীয় ম্যাচের দিনেই মুশফিক কোচকে জানিয়ে দিলেন- ধন্যবাদ আমি কিপিং করবো না। শুধু এই সিরিজেই নয়, আর্ন্তজাতিক টি- টোয়েন্টিতে আর কখনোই কিপিং গ্লাভস নেবো না। খেলবো শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে।

প্রশ্ন হলো চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটার হিসেবে মুশফিক এমন কোন শর্ত জুড়ে দিতে পারেন কিনা? দলের প্রয়োজন বলে একটা কথা আছে ক্রিকেটে। সেই প্রয়োজনে ওপেনার আতহার আলীকে নয় নম্বর পজিশনে ব্যাটিং অর্ডারেও রাখা হয়েছিল। রাহুল দ্রাবিড়কে ওয়ানডে বিশ্বকাপে উইকেটকিপারও হতে হয়েছিল।

হয়তো মুশফিকও টি- টোয়েন্টিতে কিপিংয়ের একটা সুন্দর পরিশীলত সমাধান চেয়েছিলেন। কিন্তু যে কায়দায় পুরো বিষয়টা জটিল করে তুললেন কোচ, সেটা দলের নিউক্লিয়াস ক্রিকেটারের মর্যাদায় আঘাত করল।

কিপিং ছেড়ে দিয়ে মুশফিককে দলে শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলার প্রস্তাবনার বিষয়টা বছর কয়েক থেকে চলে আসছে। মুশফিকও কমফোর্ট জোন ছাড়তে চাননি। ১৬ বছর আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে কাটানোর পর এবার যখন দেখলেন টি-টোয়েন্টিতে কিপিং নিয়ে তাকে ‘প্রাথমিকের পরীক্ষায়’ ফের খাতা কলম নিয়ে বসতে হচ্ছে; তখনই বলে দিলেন, অনেক হয়েছে ভাই-ধন্যবাদ কিপিং!

মাহমুদউল্লাহর টেস্ট ক্রিকেটকে গুডবাই, তামিমের বিশ্বকাপে না খেলা এবং মুশফিকের টি-টোয়েন্টিতে কিপিং আর না করা- এই তিন সিদ্ধান্ত জানান দিলো ক্রিকেট শুধুমাত্র ব্যাট-বলের খেলা নয়; আবেগ এবং অভিমানেরও অন্য অংশ।

অভিমান বিষয়ে কবি আবু তাহেরের দুর্দান্ত একটা পংক্তি আছে;

অভিমান করা ভালো/ অভিমান থাকা ভালো/ অভিমান পুষে রাখা ভালো নয়!