খেলাধুলা

‘বাতিল’ মাহমুদউল্লাহর হাতেই স্বপ্নের মশাল

২০১৪ এশিয়া কাপের আগে কী এক লঙ্কাকাণ্ড! আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মুশফিক জানিয়ে দিলেন, ‘আমি জানতাম না কে বাইরে যাচ্ছে আর কে দলে ঢুকছে। আমি বলব, অধিনায়ক যে-ই হোক না কেন, তার সঙ্গে দল নিয়ে কথা বলে এতটুকু সম্মান যেন দেওয়া হয়।’

টানা ব্যর্থতায় ওইবার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ দল থেকে বাদ পড়বেন তা অনুমিতই ছিল। বাদ পড়েছিলেনও। কিন্তু অধিনায়ক মুশফিক তাকে নিয়েই সাজিয়েছিলেন পরিকল্পনা! নির্বাচকদের সিদ্ধান্ত তার পছন্দ হয়নি একটুও! মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে এরকম অনেক ঝড়-ঝাপ্টা অধিনায়ক থাকাকালে সহ্য করেছেন মুশফিক। এক সংবাদ সম্মেলনে মুশফিককে কড়া প্রশ্নও করা হয়েছিল, ‘ব্যাটিং হচ্ছে না, বোলিং করাচ্ছেন না, মাহমুদউল্লাহ কোন ভূমিকায় দলে? তার কাজটা কী?’ মুশফিক শুধুমাত্র তার আস্থার কথাই বলেছিলেন। আবার শততম টেস্টের আগে হুট করে তাকে শ্রীলঙ্কা থেকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই।  

প্রতিকূল সময়গুলোতে মাহমুদউল্লাহর পরিস্থিতি এমন ছিল যে, দল ব্যর্থ হলে তার উপস্থিতি নিয়েই প্রশ্ন উঠত। গড়পড়তা পারফরম্যান্সগুলোও চলে আসত সামনে। পরিণতি দল থেকে বাদ! আবার ফিরে আসা, আবার লড়াই, আবার বাদ পড়া!

কিন্তু সেই মাহমুদউল্লাহ সময়ের সঙ্গে পরিণত হয়েছেন। পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পেয়েছেন। পারফর্মার হয়েছেন। হয়েছেন অধিনায়ক। এখন তার হাতেই লাল-সবুজের বিশ্বকাপের পতাকা। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অংশ নিতে যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সপ্তম আসরে। এর আগের ছয়টি বিশ্বকাপের আসরেই খেলেছেন মাহমুদউল্লাহ। এই কীর্তিতে তার সঙ্গে আছেন সাকিব ও মুশফিকও। ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মুশফিকের ডেপুটিও ছিলেন তিনি।

২০১৪ সালে বাংলাদেশের টানা ব্যর্থতার মাঝে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে নেতৃত্বে আনে বিসিবি। মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ারের সূর্য নতুন করে উদয় হয় তখনই। মাশরাফির অধীনে অনেকটা নির্ভার হয়েই পারফর্ম করার সুযোগ পান তিনি। মাশরাফিও তাকে দিয়েছেন সেই প্রাপ্য সুযোগ, সম্মান ও আত্মবিশ্বাস। ২০১৫ বিশ্বকাপ যার বড় প্রমাণ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাডিলেডে সেঞ্চুরি তুলে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়ের নায়ক ও বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হয়ে যান। পরের ম্যাচে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে আরেকটি সেঞ্চুরি। এরপর আর তাকে সীমিত পরিসরে ফিরে তাকাতে হয়নি।

টি-টোয়েন্টি থেকে মাশরাফির অবসরের পর ২০১৭ সালের এপ্রিলে টি-টোয়েন্টি দলের নেতৃত্ব পান সাকিব। ডেপুটি করা হয় মাহমুদউল্লাহকে। পরের বছর অনাকাঙ্খিত ঘটনায় সাকিবের পরিবর্তে মাহমুদউল্লাহ অধিনায়ক। আঙুলের চোটে সাকিব খেলতে পারবেন না। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই টি-টোয়েন্টিতে মাহমুদউল্লাহর কাঁধে নেতৃত্ব। সাকিব সুস্থ হয়ে ফিরে আসার আগে নিদাহাস ট্রফিতে তিন ম্যাচ নেতৃত্ব দেন মাহমুদউল্লাহ। বছরের শেষপ্রান্তে সাকিব এক বছর নিষিদ্ধ হলে মাহমুদউল্লাহকে পূর্ণকালীন নেতৃত্ব দেওয়া হয়।

এরপর তার হাত ধরেই চলছে বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি দল। প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে বাজিমাত। দিল্লিতে ভারতকে হারায় বাংলাদেশ। সিরিজ ২-১ এ হারলেও বাংলাদেশের দিল্লি জয়ে দারুণ উৎফুল্ল ছিল ক্রিকেটাঙ্গন। মাহমুদউল্লাহর অধিনায়কও প্রশংসিত হয় সর্বত্র। এরই মধ্যে মাহমুদউল্লাহ মাশরাফিকে ছাপিয়ে টি-টোয়েন্টিতে সফলতম অধিনায়ক হয়েছেন। ২৬ ম্যাচে জয় ও পরাজয়ের পরিসংখ্যান সমান সমান। এর মধ্যে দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয় নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে বড় অর্জন। 

কঠিন পরিস্থিতিতে বুক চিতিয়ে লড়াই করা, লোয়ার অর্ডারে দ্রুত রান তোলা, ২০ থেকে ৩০ রানের অবদান রেখে দলের স্কোরকে বড় করা, কখনও কখনও ম্যাচ জেতানো ছোট্ট ক্যামিও মাহমুদউল্লাহকে করেছে অনন্য। দলের প্রয়োজনে বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে ব্যাটিং করে কখনও সফল হয়েছেন, কখনও ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু দিনের পর দিন ক্রাইসিস ম্যান হিসেবে মাহমুদউল্লাহ টিকে ছিলেন। নায়ক হতে পেরেছেন পাঁচবার। কিন্তু অসংখ্যবার তিনি পার্শ্বনায়ক হয়ে ছিলেন। আবার বল হাতে কখনো কখনো ছড়িয়েছেন মুগ্ধতা।

তার ব্যাটে রাঙা বাংলাদেশের একাধিক ঐতিহাসিক জয়। ২০১৮ সালে নিহাদাস ট্রফিতে ছক্কা উড়িয়ে বাংলাদেশকে ফাইনালে নেওয়া, ২০১৬ টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহর জয়সূচক বাউন্ডারি বাংলাদেশের ক্রিকেটগাঁথার অবিচ্ছেদ্য অংশ, বিশ্বকাপে শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানের বিপক্ষে নান্দনিক ফিনিশ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে তার ২০ বলে ৩২ রানের মহাগুরুত্বপূর্ণ ইনিংস ও সবশেষ নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের রাতে তার অপরাজিত ৪৩ রান বাংলাদেশ ক্রিকেটের রেকর্ডবুকে জ্বলজ্বল করবে আজীবন।

১৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার তার। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অনেক উত্থান-পতন দেখেছেন। বাঁক বদল হয়েছে তার হাত ধরেও। পার্শ্বনায়ক থেকে নায়কও হয়েছেন। কঠোর পরিশ্রম, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তাড়না, অধ্যাবসায়ে মাহমুদউল্লাহ হয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটে পঞ্চপান্ডবের একজন। এবার নেতৃত্বের ভার নিয়ে যাচ্ছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। ক্যারিয়ারে অনেক চ্যালেঞ্জ জয় করা মাহমুদউল্লাহর নতুন অর্জন যুক্ত হলো। মহামূল্য মাহমুদউল্লাহ নিশ্চয়ই সৌরভ ছড়িয়ে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সাফল্য দেওয়ার চ্যালেঞ্জটাই নিবেন।