খেলাধুলা

মেকি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বকাপে যাওয়াই মূল সমস্যা

অনেক কিছুতেই সমস্যা... 

জিম্বাবুয়ে থেকে ফেরত আসার পর থেকে আমাদের দলের প্রস্তুতির যেই চিন্তা ভাবনা ছিল গলদটা সেখান থেকেই শুরু। জিম্বাবুয়ে যাওয়ার আগে আমরা সন্দিহান ছিলাম আমাদের দলটা কী হবে, কেমন হবে, কতটুকু খেলতে পারবে? জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে আমাদের শঙ্কা ছিল। জিম্বাবুয়ে শক্ত প্রতিপক্ষ না তবুও ওখানে ধারাবাহিক ফল পাওয়াতে দলটা সংঘবদ্ধ হয়েছিল। মোটামুটি একটা দল নিয়ে আমরা ফেরত আসতে পেরেছিলাম। 

কিন্তু ওখান থেকে আসার পর ঘরের মাঠে যে দুইটি সিরিজ খেলেছি আমাদের এখনকার সমস্যার সূত্রপাত ওখান থেকেই শুরু হয়েছিল। আমরা যেটাকে বলছি, আত্মবিশ্বাস! সেটা আমাদের জন্য উল্টো শাপে বর হয়েছে। যা এখন ভোগাচ্ছে। যে আত্মবিশ্বাস, যে দলীয় জয়ের কথা আমরা বলছি সত্যিকার অর্থে কোনো কাজে আসছে না। এটা অনেকটা না পড়াশোনা করে পাস করার মতো। 

আজ বাংলাদেশ কেন পারছে না সেটার মূল আসলে সেই দুই সিরিজ। সেই মেকি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হলাম। ওয়ার্মআপ থেকে শুরু হয়েছিল। ওয়ার্মআপ থেকে ওই মেকি আত্মবিশ্বাস উন্মুক্ত হওয়া শুরু হলো এবং সেখান থেকেই নেতিবাচক ফল, বাজে পারফরম্যান্স আসার সূত্রপাত। 

এসব বিষয় ম্যানেজ করার জন্য যেসব জিনিস দরকার ছিল, সবার এক হওয়া দরকার ছিল। সংঘবদ্ধ হওয়া দরকার ছিল এবং বোঝা উচিত ছিল এ কারণে সমস্যা হচ্ছে। আবার একজন আরেকজনকে দোষারোপ করছে। ম্যানেজমেন্ট খেলোয়াড়দের, আর খেলোয়াড়রা ম্যানেজমেন্টকে।আবার দর্শকরা খেলোয়াড়দের দোষ দিচ্ছেন। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দিক থেকে এগুলো হয়েছে। এগুলো হওয়া উচিত ছিল না। এসব কাজ বাদ দিয়ে দলটাকে নতুন করে তৈরি করা দরকার ছিল। অথচ আমরা পরিস্থিতিগুলোকে সামলে না নিয়ে আরো খারাপের দিকে নিয়ে গেছি। যেতে যেতে এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে একেবারে তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আত্মবিশ্বাসের ব্যাপারটাই আমাদের যত ক্ষতি করেছে। 

মূলত যেটা হয়েছে... খেলোয়াড়দের কিন্তু স্কিল বদলে যায় না। যেটা হয় আত্মবিশ্বাস, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। যদি উদাহরণ দেই, পাকিস্তান দল কি এমন ছিল কিছুদিন আগে? মোটেও না। কিন্তু এখন ওই জায়গায় চলে এসেছে যে ওরা যে কোনো দলকে হারাতে পারবে। শ্রীলঙ্কাও তাই। ওরা এমন কী দল? কিন্তু ওরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলছে। সামনে কতটুকু পারবে না পারবে, সেটা পরের ব্যাপার। কিন্তু ওদের দেখলে আত্মবিশ্বাসটা চোখে পড়ছে। আত্মবিশ্বাস থাকলে নিজের পুরোপুরি সামর্থ্য অনুযায়ী খেলা যায়। ওই জায়গায় আমরা দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি কিছুদিনের পরিকল্পনায়, আমাদের ব্যবহার এবং সবকিছু মিলিয়ে। সেটারই ফলশ্রুতি এই খারাপ খেলা। 

ব্যাটসম্যানরা ব্যাটিং ভুলে গেছি এমনটা আমি মনে করি না। তবে খেলা দেখলে বোঝা যায়, দল জিতবে কেউ চিন্তা করার সুযোগই পাচ্ছে না। ব্যাটসম্যানরা যখন মাঠে যাচ্ছে তখন সে চিন্তা করছে আমি রান করতে পারব কি না, কিছু রান করলে আমার একটা সম্মান থাকবে, এসব। তাদের সবার মধ্যে এগুলো কাজ করছে। এসব চিন্তা নিয়ে এত বড় মঞ্চে খেলা যায় না। এখানে প্রতিপক্ষকে নিয়ে আমি চিন্তা করব। কোন বোলারকে আমার খেলতে হবে, কেমন করে খেলতে হবে, কোথা দিয়ে রান করব... এসব চিন্তা করতে হবে। অথচ আমি চিন্তা করছি, কালকের ম্যাচে গিয়ে যদি আমরা হারি, আমি যদি রান না করি, যদি খেলতে না পারি তাহলে কী হবে! প্রত্যেকে নেতিবাচক চিন্তায় ভরপুর। বিশেষ করে ব্যাটসম্যানরা। তারা তো একেবারে তলানিতে। আমাদের প্রতিপক্ষ কিন্তু এগুলো জানে আমাদের মানসিক অবস্থানটা কী। এজন্য ওরা সেই সুযোগটি নিয়ে চাপ দিচ্ছে। 

বাইরের চিন্তায় তাদের মনোবল নষ্ট হচ্ছে। বাইরের মানুষ কী ভাবছে, কী বলছে এসব চিন্তা হচ্ছে কিন্তু এগুলো একদমই হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে এটা হয়। আমরা খুব সহজলভ্য। খেলোয়াড়রা মানুষের খুব কাছাকাছি থাকে। মানুষও খেলোয়াড়দের কাছাকাছি থাকে। মিডিয়াও খেলোয়াড়দের খুব কাছাকাছি থাকে। তারাও থাকে। ফেস টু ফেস হয়ে যায়। যখন ভালো খেলে বা মোটামুটি ভালো খেলে তখন প্রচুর প্রশংসা পায়, অনেক সময় যেই প্রশংসা প্রাপ্য না সেটাও পায়। কিন্তু যখন আবার খারাপ খেলে তখন আবার সেটা ফেরত পায়। এই জিনিসটা একদমই ফেস টু ফেস হয়। এটা সামলে নেওয়ার অভিজ্ঞতা, ট্রেনিং কোনো কিছুই আমাদের খেলোয়াড়দের নেই কিন্তু। হাতে গোনা দুয়েকজন এগুলো ম্যানেজ করতে পারে। বেশিরভাগই ভেঙে পড়ে। তখন ওরা সহজ পথ খোঁজার চেষ্টা করে কিভাবে ওখান থেকে বাঁচবে। খেলাধুলার চিন্তাটা তখন কমই থাকে। প্রতিপক্ষকে নিয়ে চিন্তা করা সেসব আর করে না। মনের ভেতর থেকে হয়তো আসে না। হয়তো পরিকল্পনা করে, আলাপ করে, বৈঠক করে কিন্তু ডিপ ইনসাইডে খুব অনিরাপত্তায় ভোগে এবং ওখান থেকে বের হওয়াটা খুব সহজ না।

শেষ কয়েকবছরে সৌম্য, লিটন বা যারাই এসেছে তারা চেষ্টা করেনি সেটা বলব না। কিন্তু নিজেকে আরেকটা উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যে তাড়না, মরিয়া হয়ে খাটা সেই ব্যাপারগুলো মিসিং। যে পরিবেশে আমাদের খেলোয়াড়রা থাকে সেই পরিবেশ কিন্তু মোটিভেশন পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত না। ওরা যে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে, যে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট বা ক্লাব ক্রিকেট খেলে সেখানে এগিয়ে যাওয়ার পরিবেশ নেই, কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। তারপরও কোনো ব্যক্তি ক্রিকেটার যদি চায় তাহলে নিশ্চয়ই তার সেই উদ্যোগ থাকতে পারে। 

সমস্যা হলো, আমরা আমাদের যে পাশের খেলোয়াড় তার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করি। আমি হয়তো রাজশাহীর খেলোয়াড়, আমি খুলনার খেলোয়াড়ের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করি। কিন্তু সত্যিকারের ভালো খেলোয়াড় হতে হলে আন্তর্জাতিকভাবে আমার সমপর্যায়ের খেলোয়াড় যারা তাদের সঙ্গে তুলনা করে নিজেকে উন্নতি করতে হবে। তাহলে নিজের অবস্থান স্পষ্ট হবে। আন্ডার নাইন্টিন খেলা প্লেয়ার খুব নামিদামি হয়ে আছে এখানে কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কিছুই করতে পারছে না। কিন্তু একই পর্যায়ের অন্য দেশের খেলোয়াড় টপ খেলোয়াড় হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তুলনা ওরকম করা উচিত। যারা ঘরোয়া ক্রিকেট খেলছে তারা যদি নিজেদেরকে এই সার্কেলে আটকে রাখে তাহলে কোনো উন্নতি করতে পারবে না। তাদের সমকক্ষ হতে হবে এবং সেই চেষ্টা থাকতে হবে। এজন্য মরিয়া হয়ে থাকতে হবে। এটা তো নিজেদের চিন্তা করতে হবে। এটা তো একটা শিল্পর মতো। আমি একজন শিল্পী হয়ে যদি নিজেকে সেরা বানানোর চিন্তা না থাকে তাহলে আমি কোথাও যেতে পারব না। 

আমাদের ক্ষুধা কম তো অবশ্যই। তাই পরিশ্রমটাও কম। পরিকল্পনায় ঘাটতি। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জেদও নেই। জিনিসটা শুধু কিন্তু খেলোয়াড়দেরই না। কার ক্ষুধা আছে? আমাদের মধ্যে সামগ্রিকভাবে কারো ক্ষুধা নেই। আমাদের টার্গেট কি? আমি একটা ক্লাব চালাই চ্যাম্পিয়ন হলেই খুশি। কিন্তু আমার ক্লাবের প্লেয়ার আন্তর্জাতিক মানের হয়ে গড়ে উঠছে কি না সে ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমার ক্লাবের খেলোয়াড় এক মাস পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে যাবে সেটা নিয়ে আমি চিন্তাও করি না।

লেখক: বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা ও বিসিবির সাবেক কোচ।

অনুলিখন: ইয়াসিন হাসান