খেলাধুলা

ধারাবাহিকতার অনন্য নিদর্শন এই নিউ জিল্যান্ড

২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সালে- এই ছয় বছরে নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটে ঘটে গেছে অনেক কিছু। এর মধ্যে আইসিসির চারটি বৈশ্বিক ইভেন্টের ফাইনালে নাম লিখিয়েছে। ২০১৫ ও ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে হারতে হয়েছে, আর প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল জিতেছে। চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালেও তারা। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ট্রফির লড়াই হবে একদিন পর ১৪ নভেম্বর দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে।

এক ক্রিকেট ভক্ত নিছক মজার ছলে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আইসিসির যে কোনো ইভেন্ট হলেই নিউ জিল্যান্ডকে ফাইনালিস্ট ধরে বাকিটা হিসাব করতে হবে। কিছু হোক আর না হোক তারা ফাইনালে যাবেই।’

আসলেই তো, সেটাই ঘটে চলেছে। অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের ঠাণ্ডা মেজাজের নেতৃত্বে একের পর এক বিপ্লব ঘটাচ্ছে নিউ জিল্যান্ড। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চের ফাইনালে হারের পর তাকে দেখা যায় ভাবলেশহীন, যেন কিছুই হয়নি। এবারো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল নিশ্চিতের পর দলের সঙ্গে তার একটি ছবি আলোচিত হয়, এক কোণে তিনি বসে আছেন, নজর সামনে, ঠোটে স্মিত হাসি। কিন্তু তার অবস্থা দেখে মনেই হয়নি কয়েক সেকেন্ড আগে তার দলই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে নিশ্চিত করেছে ফাইনাল। এমন ধীরস্থিরতার জন্য তাকে ক্রিকেটের ঋষিও বলা হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেটের সবচেয়ে ধারাবাহিক দল নিউ জিল্যান্ড। সেটি টেস্ট-ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি। টেস্ট ও ওয়ানডে র‌্যাংকিংয়ে তারা শীর্ষস্থানে। আর টি-টোয়েন্টিতে অবস্থান চারে। ওয়ানডেতে সর্বশেষ দুটি বিশ্বকাপের ফাইনালই খেলেছে তারা। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হারতে হয় আর ২০১৯ সালের লর্ডসে হতে হতেও হয়নি। দুই বছর পর চলতি বছরের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতকে গুঁড়িয়ে জেতে ট্রফি। কয়েক মাস না যেতেই আবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে। এই ফরম্যাটের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো ফাইনাল নিশ্চিত করেছে তারা।

মাত্র অর্ধকোটির কিছু বেশি জনসংখ্যার দেশটির ক্রিকেটে এমন টানা সাফল্য চোখে পড়ার মতো। টেস্ট-ওয়ানডে-টি টোয়েন্টি; তিন ফরম্যাটে প্রায় আলাদা দল। নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটের সঠিক দিক নির্দেশনার সঙ্গে ক্রিকেটারদের নিবেদন-তাড়না আর স্পিরিট মিলিয়ে এমন ফল সম্ভব হয়েছে। তিন সংস্করণে প্রায় আলাদা দল হলেও এটিকে এক সুতোয় গেঁথেছেন উইলিয়ামসন। এই বিশ্বকাপের আগে পুরো দলই ছিল বিশ্রামে। কয়েকজন আইপিএলে খেলেছেন। বাংলাদেশে খেলতে এসেছিল ভিন্ন একটি দল, পাকিস্তানেও একই দল নিয়ে খেলার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা বাতিল হয়। 

তাদের বদলে যাওয়ার পেছনে একটি ঘটনাও আছে। ২০১৩ সালে কেপটাউনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাত্র ৪৫ রানে অলআউট হয়েছিল। এরপর তৎকালীন কোচ মাইক হেসন ও অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম দলের মানসিকতা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলেন। উইলিয়ামসন ও ট্রেন্ট বোল্টদের মতো আজকের তারকারা দলে তখনো তরুণ। সঙ্গে ছিলেন রস টেলরের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররাও। তাদের নিয়েই হেসন-ম্যাককালাম দিলেন পরিবর্তনের ডাক। এরপর যে শুরু আর পেছনে তাকাতে হয়নি।

নেতৃত্ব হাত বদলে এসেছে উইলিয়ামসনের হাতে। কোচিংয়ে এখন গ্যারি স্টিড। একটু ছোট পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সব ফরম্যাট মিলিয়ে নিউ জিল্যান্ড খেলেছে ৩১১ ম্যাচ। তার মধ্যে জয় পায় ১৭১টি, হার ১০৯টি, টাই ৫টি, ১৬টি ড্র আর ১০টির কোনো ফল হয়নি। জয়-পরাজয়ের অনুপাত ১.৫৮। আর এর আগে ২০০৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত খেলে ২৫৭ ম্যাচ। তার মধ্যে জয় ১০৪, হার ১২৪ ম্যাচে, ড্র ১৪টিতে আর ১১টিতে কোনো ফল আসেনি।  

অধিনায়ক হিসেবে উইলিয়ামসন নিউ জিল্যান্ডকে ৭৮টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জয় পেয়েছেন ৪২টিতে আর হার ৩৩টিতে। ওয়ানডেতে অধিনায়ক উইলিয়ামসনের ব্যাটিং গড় ৪৯.২৩। টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৩৭টি ম্যাচে। জিতেছেন ২২টিতে আর হার ৮টিতে। টেস্টে অধিনায়ক উইলিয়ামসনের ব্যাটিং গড় ৬১.৪০। আর টি-টোয়েন্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৫৫টিতে, জিতেছেন ২৮টি আর হেরেছেন ২৬টিতে। টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটিং গড় ৩১.৫৪।

ইংলিশদের হারিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার পর উইলিয়ামসন বলেছেন, ‘আমরা জানি সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ আসতে যাচ্ছে। আজ রাতে পর আমাদের ফোকাস থাকবে সেখানেই।‘

ঊনিশের ওয়ানডে বিশ্বকাপ মুখের খাবাড় কেড়ে নেওয়ার মতো ট্রফি ছিনিয়ে নিয়েছিল ইংল্যান্ড। আরো শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল নিজেদের করে নিয়েছে কিউইরা, এবার টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বসেরা হওয়ার পালা। ক্রিকেটের ঋষি কি পারবেন?