খেলাধুলা

তাইজুলের সোনামাখা দিনের সলিল সমাধি

তাইজুল ইসলামকে বর্ণণা করার জন্য হুমায়ূন আহমেদের একটি উক্তি শ্রেয় হতে পারে, ‘আমি ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া, জোছনা ধরিতে যাই। হাত ভর্তি চাঁদের আলো, ধরতে গেলেই নাই।’

তাইজুল চাইলে হাসতে পারেন। গলা ফাঁটিয়ে উল্লাসে মাততে পারেন। ছয় মাস পর মাঠে নেমে যে মায়াবী জাদুতে বুঁদ করে রেখেছিলেন সেজন্য করতালি পেতে পারতেন। দিন শেষে তার ছবিটা হতে পারতো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি কিংবা সমর্থকদের প্রোফাইল পিকচার বা ইনস্টাগ্রাম স্টোরি। কিন্তু সতীর্থ ব্যাটসম্যানদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিংয়ে তার সোনামাখা দিনটির সলিল সমাধি হলো। হাতভর্তি অর্জন কিন্তু কোনো আনন্দ নেই।

এ নিয়ে অবশ্য তার অভিযোগ বা হতাশা নেই, ‘আসলে হতাশার মতো নিলে হবে না, হতাশার মতো নিচ্ছি না। কারণ, ক্রিকেট খেলাটাই এরকম। অনেক সময় অনেক অঘটন ঘটতে পারে। আসলে কেউ ইচ্ছা করে তো আউট হতে চায় না। প্রথম ইনিংসেও আমাদের ৪ উইকেট তাড়াতাড়ি পড়েছিল। তারপর আমরা কামব্যাক করেছি। আমরা আত্মবিশ্বাস রাখছি যে আমরা আবার কামব্যাক করবো।’

অদম্য মানসিকতা না থাকলে এমনটা হওয়া অসম্ভব। সাত-আট মাস পর জাতীয় দলে আসবেন, এসেই দলের সেরা তারকা হবেন! এজন্য দৃঢ় সংকল্পবোধ লাগবেই। তাইজুল সেই দলের একজন যারা এসেই বাজিমাত করেন।

সবশেষ টেস্ট খেলেছিলেন গত মে’তে। সেই ম্যাচেও পেয়েছিলেন ৫ উইকেট। ছয় মাস পর আবার তার গায়ে জাতীয় দলের জার্সি। ফিরে এসে তার শিকার ৭ উইকেট। ধ্রুপদী স্পিনে পাকিস্তানকে একাই নাড়িয়ে দিয়েছেন বাঁহাতি স্পিনার। বাংলাদেশের করা ৩৩০ রানের জবাবে পাকিস্তান গুটিয়ে যায় ২৮৬ রানে। ৪৪ রানের লিড পায় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে তৃতীয়বার লিড। অথচ এমন একটি দিনেও ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় পাকিস্তান শিবিরে জয়ের পূর্ভাবাস!

লিড নিয়ে ব্যাটিং করতে নেমে টপ অর্ডারের ব্যর্থতায় ৪ উইকেটে বাংলাদেশের রান ৩৯। সব মিলিয়ে ৮৩ রানের লিড থাকলেও তৃতীয় দিন শেষে অস্বস্তিতে বাংলাদেশ।

দিনের শুরুতে তাইজুলের প্রথম ওভারে জোড়া উইকেট। কয়েক ওভার পর আবার তার শিকার ফাওয়াদ আলম। প্রথম সেশনে একটানা ১৬ ওভার করে পেলেন ৩ উইকেট। শান্ত ক্যাচ মিস না করলে ১১৩ রানে থাকা আবিদ আলীর উইকেটও পেতে পারতেন সকালে। কিন্তু তাকে অপেক্ষায় থাকতে হলো। দ্বিতীয় সেশনে পাকিস্তানের ওপেনার ও সেঞ্চুরিয়ানকে ঠিকই নিজের শিকারে পরিণত করলেন। তার শার্প টার্ন বল স্কিড করে আবিদের প্যাডে আঘাত করে।

সেঞ্চুরিয়ানের ইনিংসটি থামে ১৩৩ রানে। এরপর হাসান আলীকে স্ট্যাম্পড করে ফাইফারের স্বাদ নেন। অতিথি শিবিরের শেষ দুটি আঘাতও করেন তিনি। নোমান আলী ও ফাহিম আশরাফের উইকেট নিয়ে ৭ উইকেটের স্বাদ নেন তাইজুল। ১১৬ রানে ৭ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডটা তার নামেই লিখা রইলো।

আগের দিন কোনো উইকেট না হারিয়ে ১৪৫ রান তোলা পাকিস্তান তাইজুলের ঘূর্ণিতে আজ সবকটি উইকেট হারিয়ে যোগ করে ১৪১ রান। তাইজুলের ৭ উইকেটের সঙ্গে ইবাদতের ২ ও মিরাজের উইকেট নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় প্রথম ইনিংসে।

অথচ বাংলাদেশের টপ অর্ডার আবারও ‘টপলেস’। প্রথম ইনিংসে ৪৯ রানে ৪ উইকেট হারানো বাংলাদেশ এবার ৪ উইকেট হারালো ২৫ রানে। এর মধ্যে মুমিনুল ও শান্ত ইনিংসের খাতাই খুলতে পারেনি। সাদমান করেছেন ১ ও সাইফের ব্যাট থেকে আসে ১৮ রান।

আফ্রিদির এক স্পেলে লণ্ডভণ্ড বাংলাদেশের টপ অর্ডার। সাদমান ইসলাম প্রথম ইনিংসের মতোই ডাউন দ্য লেগ বলে এলবিডব্লিউ। শান্তও তাই। অফস্টাম্পের বাইরের বল অ্যাওয়ে ফ্রম দ্য বডি খেলতে গিয়ে ক্যাচ দেন প্রথম স্লিপে। সাইফ প্রথম ইনিংসের মতোই শিশুতোষ ভুলে সাজঘরে। শর্ট বলে জড়তা থাকায় তাকে আফ্রিদি ও হাসান আলী বারবার শর্ট বল করে যাচ্ছিলেন। সেখানেই বিপদ। আফ্রিদির এক শর্ট বল চোখ এড়িয়ে খেলতে গিয়ে ফিরতি ক্যাচ দেন। মুমিনুল ফিরেছেন সবচেয়ে বাজে বলে। হাসান আলীর প্রায় সোজা বল ক্রস খেলতে গিয়ে ক্যাচ দেন শর্ট মিড উইকেটে।

দ্রুত ৪ উইকেট হারানো বাংলাদেশ আবারও আস্থা পায় মুশফিকের ব্যাটে। এবার তার সঙ্গী ইয়াসির। দুজনের জমাট ব্যাটিংয়ে শেষ বিকেলে আর কোনো বিপদ বাড়েনি। মুশফিক ১২ রানে অপরাজিত থাকেন। এ ইনিংস খেলার পথে দেশের হয়ে টেস্টে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি নিজের করে নেন। ইয়াসিরের ব্যাট থেকে আসে ৮ রান।

প্রথম ইনিংসের মতো ধ্বংসস্তৃপ থেকে মুশফিক দলকে উদ্ধার করতে পারেন কিনা সেটাই দেখার। 

বাংলাদেশের মূল অস্ত্র স্পিন। পাকিস্তানের পেস। দুই দলই শক্তির প্রদর্শনীতে এখন পর্যন্ত সফল। ব্যাটসম্যানরাই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। শেষ পর্যন্ত কাদের মুখে ফুটবে হাসি? ম্যাচে যে ফল বেরোবে তা নিশ্চিত করে বলাই যায়।