খেলাধুলা

লাল বলের ব্যর্থতায় ঢাকা পড়ল সাদা বলের সাফল্য

শেষ হওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে সাদা বলের ওয়ানডে সিরিজে সাফল্যের সূর্যালোক ছিল। আবার চাঁদের অন্য পিঠের মতো লাল বলের টেস্ট সিরিজে দেখল অমাবস্যার ঘুটঘুটে আঁধার। এ যেন ঠিক মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। কেউ আশা করেনি দুর্দান্ত ফর্মে থাকা প্রোটিয়া ওয়ানডে দলের বিপক্ষে সিরিজ জিতবে বাংলাদেশ ওদেরই আঙিনায়। পূর্ণ শক্তির দক্ষিণ আফ্রিকা দলের বিপক্ষে ঐতিহাসিক ২-১ সিরিজ জয়ে যেমন সমন্বিত দলীয় শক্তির দ্যুতি ছিল, ঠিক তেমনই টেস্ট সিরিজে লজ্জাজনক ধবল ধোলাই ছিল গোটা দলের সমন্বিত ব্যর্থতা। 

শুধুমাত্র অর্জন বলতে প্রথম টেস্টে নবীন মাহমুদুল হাসান জয়ের প্রশংসনীয় ১৩৭ রানের একটি ইনিংস এবং দ্বিতীয় টেস্টে অভিজ্ঞ তাইজুল ইসলামের বোলিং। ২২০ এবং ৩৩২ রানের ব্যবধানের টেস্ট পরাজয়ে আর কিছুই বলার থাকে না। 

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের যেই দলটি নিউ জিল্যান্ডে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছিল, সেই দলে তামিম, মুশফিক ছিলেন না। এবারের দলটিতে প্রথম টেস্টে তামিম শেষ মুহূর্তে পেটের পীড়ায় ছিটকে পড়ে খেলেননি। তারপরেও যে দল নিয়ে বাংলাদেশ টেস্ট সিরিজ খেলেছে, বিশ্বজুড়ে টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতায় দলটি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে ছিল। দলের কোচিং স্টাফে প্রোটিয়া রাসেল ডমিঙ্গো ও অ্যালান ডোনাল্ড থাকায় বড় কিছু অর্জনের প্রত্যাশা ডানা মেলেছিল। বাংলাদেশের টেস্ট দল সিরিজ শুরুর আগে বেশ কিছু দিন গ্যারি কারস্টেন একাডেমিতে অনুশীলন করেছিল। এই প্রথম বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার দুটি মূল ক্রিকেট ভেন্যু ডারবানের কিংসমিড এবেখার সেন্ট জর্জেস পার্কে খেলার সুযোগ পেলো। ওয়ানডে সিরিজ শেষে যেই না টেস্ট সিরিজ শুরু, বাংলাদেশ দলের মাইন্ডসেট পাল্টে গেল। সাকিব আল হাসান পারিবারিক কারণে টেস্ট সিরিজে অনুপস্থিত। প্রথম টেস্ট শুরুর আগে মুহূর্তে তামিম পেটের পীড়ায় ছিটকে পড়লেন। টেস্ট ম্যাচ জিততে একাদশে অন্তত ৫ জন মেইন  স্ট্রিম বোলার অপরিহার্য। ডারবান উইকেটে স্পিন ধরার ইতিহাস থাকলেও দলের অন্যতম সেরা স্পিনার তাইজুলকে দলের ভারসাম্যের ঠুনকো অজুহাতে একাদশে রাখা হলো না।  টস জিতেও অপেক্ষাকৃত খর্ব শক্তির স্থানীয় দলের বিপক্ষে ব্যাটিং করার সাহস দেখাতে পারলেন না অধিনায়ক মুমিনুল হক। এই দুটি ভুল সিদ্ধান্তই বাংলাদেশকে চরম বিপদে ফেলল।   বাংলাদেশ ছন্নছাড়া বোলিংয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ইনিংসে তুলল সাড়ে তিনশ’র ওপর। অনেকেই বলেছেন তাইজুলসহ পাঁচ বোলার থাকলে ওদের প্রথম ইনিংস সংগ্রহ কিছুতেই ৩০০ পার হতো না। যেভাবে প্রোটিয়া দল ব্যাটিং করেছে, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যাটিং করলে বাংলাদেশ অবশ্যই ৩৫০ রান করতে পারতো। কিন্তু প্রথম ইনিংসে একমাত্র নবীন মাহমুদুল হাসান জয় ও লিটন ছাড়া কেউ দাঁড়াতেই পারল না দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় সারির বোলিংয়ের মোকাবিলায়। ফলাফল প্রথম পিছিয়ে থেকে ওদের বড় টার্গেট গড়ার সুযোগ করে দেয়া। 

তবু বলব, ভালো বোলিং করে দ্বিতীয় ইনিংস টার্গেট ধরাছোঁয়ার মাঝে রেখেছিল। ওই যে চার বোলার খেলানোর সনাতন কৌশল। এখানেই মার খেল বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে উল্লেখযোগ্য সময় জুড়ে তাসকিন চোটের কারণে বল করতে না পারায় তিন বোলারে সীমিত ছিল বাংলাদেশের আক্রমণ। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস কেশব মহারাজ (বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার) ও দীর্ঘদেহী অফস্পিনার সিমন হার্মার ধসিয়ে দিলো। ওদের যুগল আক্রমণে মাত্র ১৯ ওভারে ৫৩ রানে সাঙ্গ হওয়া ইনিংসটি ছিল ডারবানে নিম্নতম স্কোর। বিশাল ব্যবধানে হারের কলঙ্ক তিলক পড়ল বাংলাদেশ। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় মুশফিক, মুমিনুল সহ ব্যাটিং তাসের ঘরের মতো ঝরে পড়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ পাওয়া গেল না।   মহারাজ-হার্মার জুটি ১৯ ওভার অবিচ্ছিন্ন বোলিং করে যেভাবে বাংলাদেশকে পাড়ার দলে পরিণত করেছে সেটি দেখে আফসোস করতেই হয়, বাংলাদেশ ১৯৭০-১৯৮০ ক্রিকেটে ফিরে গেল কিনা?   দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে প্রথম টেস্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে, এই আশা ছিল। এই টেস্টে তামিমের প্রত্যাবর্তন দলকে ভরসা যোগায়। প্রথম টেস্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে তাইজুলকে আর অবহেলা করার সাহস করেনি বাংলাদেশ। কিন্তু এবারো ৪ বোলার নিয়ে খেলল বাংলাদেশ। 

টস হেরে বোলিংয়ে নামল বাংলাদেশ। চার বোলার নিয়েও প্রথম দিন মন্দ করেনি। কিন্তু দ্বিতীয় দিন মহারাজা (৮৪) ভালো ব্যাটিংয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা তুলল ৪৫৩ রান। তাইজুল ৬ উইকেট তুলে নিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন তাকে ডারবান টেস্টে না নিয়ে কী ভুল করেছিল বাংলাদেশ!   বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে আদৌ কোনো পরিকল্পনার ছাপ ছিল না। তামিম ৪৭ রানের ইনিংস খেলার পর আত্মাহুতি দিলেন। প্রথম টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদুল হাসান জয় ব্যর্থ হলেন। অধিনায়ক মুমিনুল, লিটন কিছু করতে পারলেন না। সবচেয়ে দৃষ্টিকটু হলো দীর্ঘদিন পর রানে ফেরা মুশফিকের কাণ্ডজ্ঞানহীন আত্মাহুতি। ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায় ৫১ রান করা মুশফিক উইকেট বিলিয়ে দিলেন রিভার্স সুইপ খেলার নেশায়।   ডিন এলগার সৌজন্য করে ফলোঅন না করানোয় বাংলাদেশ আরো নিদারুণ লজ্জা থেকে রক্ষা পেল। নাহলে তৃতীয় দিনেই হয়তো বাংলাদেশ আরো একটি ইনিংস পরাজয়ের লজ্জা পেতো।  সীমিত ওভার ঢঙে ব্যাটিং করে দক্ষিণ আফ্রিকা ১৭৬/৬ করে ইনিংস ঘোষণা করে ৪১৩ রানের পাহাড়সম টার্গেট দিয়েছিল। এই ইনিংসেও ৩টি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন তাইজুল। ম্যাচে তার শিকার ২০২ রানে ৯ উইকেট। বাংলাদেশ দিন শেষে ২৭ রান তুলতেই তামিম, জয়, শান্তকে হারায়। প্রথম টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান জয় এবার পেলেন জোড়া শূন্য! চতুর্থ দিন সকালে সেই মহারাজ-হার্মারের স্পিন ছোবলে আত্মসমর্পণ করল বাংলাদেশ। ৮০ রানে গুটিয়ে গেল। ৩৩২ রানের বিশাল হার। সেই সঙ্গে আরো একটি টেস্ট সিরিজ ধবলধোলাই।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ক্রিকেট বিশ্লেষক।