খেলাধুলা

কমিটমেন্টে মুশফিক ১০ এ ১০, পারফরম্যান্সে ৮.৫-৯

ক্রিকেটাররা যখন অফ ফর্মে থাকেন কিংবা ছন্দ হারিয়ে নিজেদের খুঁজতে থাকেন, ছুটে যান শৈশবের গুরুর কাছে। ব্যতিক্রম নন মুশফিকুর রহিমও। রান ছিল না তার ব্যাটে। মাঠের বাইরে নানা আলোচনায় মুশফিকের ওপর ছিল পাহাড়সম চাপ। নিজেকে ফিরে পেতে শরনাপন্ন হয়েছেন ‘গুরু ফাহিম স্যার’ খ্যাত নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাছে। তাতে মিলল সুফল। 

রানে ফিরে মুশফিক পেয়েছেন সেঞ্চুরি। শিষ্যকে নিয়ে কি কাজ করেছেন জানতে চাওয়া হয়েছিল নাজমুল আবেদীনের কাছে। রাইজিংবিডির মুখোমুখি হয়ে আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি, 

ব্যাটিংয়ে কোথায় কাজ করেছেন আপনারা?

নাজমুল আবেদীন ফাহিম: অতো গভীরভাবে তো বলা সম্ভব নয়, তবে যতুটুকু বলা যায়— আমরা বেসিক জিনিসগুলো নিয়েই কাজ করেছি। অনেক সময় হয় কি, ফর্ম না থাকলে, দ্রুত আউট হয়ে গেলে, রানে না থাকলে ফিরে আসার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে। তখন টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে একটু কাজ করা হয়। অনেক সময়, দীর্ঘদিন নিজের দুর্বলতা নিয়ে কাজ না করলে ওই জিনিসগুলো বড় হয়। স্বাভাবিকভাবেই রান পেলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। আর সেসব নিয়ে কাজ হয় না। তাই আমরা সেসব জিনিসগুলো নিয়েই কাজ করেছি।

কোথায় সমস্যা হচ্ছিল সেটা আইডেটনিফাই করা কঠিন। কারণ, এখন কেউ-ই নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বের হয় না। সেক্ষেত্রে আপনাদের কাজটা শুরু হয়েছিল কিভাবে?

নাজমুল আবেদীন ফাহিম: ও যখন ভালো করছিল না তখন থেকেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছিল। আমরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করছিলাম। যেহেতু ও নিজেও ব্যস্ত থাকে, সেভাবে কাজ করার সুযোগ হয় না। আমরা ঈদের বিরতিতে কাজ করেছি। ওই সময়ে আমরা কাজ করেছি। রান পাচ্ছিল না তাই একটু আপসেট ছিল। তাই আমাদের আলোচনা করে বের করতে হয়েছে কোথায় সমস্যা হচ্ছিল।

মুশফিক আপনার কাছে যখন এসেছিল মানসিকভাবে তাকে কেমন দেখেছিলেন?

নাজমুল আবেদীন ফাহিম: ওকে আমি মানসিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানেই দেখেছি। দ্বিতীয় দিনের মধ্যেই ও বুঝে গিয়েছিল কোথায় সমস্যা হচ্ছিল। এরপর সেসব শুধরে নিয়ে এগিয়ে যায়। খুব স্বস্তি নিয়ে এরপর ব্যাটিং করছিল। তখনই মনে হচ্ছিল সামনের সিরিজে ভালো কিছু আসতে যাচ্ছে। কারণ, কঠিন সময় কাটানোর পর যখন নিজের ভুলগুলো কেউ বেসিক থেকে শুধরে নেয় তখন ভালো ফল পাওয়া যায়। এখন সেঞ্চুরি করেছে বলেই কথাগুলো বলা তা না। ওকে নেটে এভাবেই দেখেছি। 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মুশফিকের থেমে যাওয়ার সময় এখনো এসেছে?

নাজমুল আবেদীন ফাহিম: এটা তো আসলে নির্বাচকরা ভালো বলতে পারবেন। আর তারা কাদের ওপর জোর দিচ্ছেন, ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করছেন তারা বলতে পারবেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই আমাদের তেমন স্ট্যাবল দল আছে কিনা যে, আমরা মুশফিককে ছাড়াও চিন্তা করতে পারি। ওয়ানডে বা টেস্টে। আমি সরাসরি বলবো, নেই। টি-টোয়েন্টিতেও মুশফিক ভালো করবে। ওর ন্যাচারাল স্ট্রোক খেলতে পারে। নির্বাচকদের অনেক ভাবনা, পরিকল্পনা থাকতে পারে। খুব স্বাভাবিক এটা। এই আলোচনাটা এমনভাবে হওয়া উচিত না, এমন একটা সময়ে যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট চলছে বা সেই খেলোয়াড় চাপের মধ্যে আছে। এটা সেই খেলোয়াড়কে পারফরম্যান্স করা থেকে আটকে দেয়। এগুলো নিজেরা নিজেরা আলোচনা হতে পারে। যে কাউকে নিয়েও আলোচনা হতে পারে। তবে একটা সুস্থ প্রক্রিয়ায়। একটা ভালো সংস্কৃতি সেটআপ করা জরুরি।

কোচরা অনেক সময় পিঠ চাপড়ে দিলেও সাহস বেড়ে যায়। আপনার ও মুশফিকের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তা হয়েছে। ছাত্র হিসেবে মুশফিককে কত দেবেন?

নাজমুল আবেদীন ফাহিম: মুশফিকের যে কমিটমেন্ট এজন্য তাকে দশে দশই দিতে হবে। ওর যে চেষ্টা, একাগ্রতা সেজন্য ও ফুল মার্কস পাবে। সেটা অন্য সবার থেকে এগিয়ে থাকবে। আবার ওর যে সামর্থ্য ছিল, ওর আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। সেখানে হয়তো দশে সাড়ে আট বা নয় এরকম হবে। আরও বেশি রান করার, সেঞ্চুরি করার যোগ্যতা ছিল।

আজ সেঞ্চুরি করলো, ৫ হাজার রান করলো— তার এই অর্জনকে কিভাবে দেখছেন?

নাজমুল আবেদীন ফাহিম: এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার কাছে এখনই এতোটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। ৫ হাজার রান করতে মুশফিক কতোগুলো ইনিংস খেলেছে, সেই ইনিংসগুলো কতোটা মিনিংফুল ছিল সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটা ইনিংস দলে সাফল্য পেতে কতোটা ভূমিকা রেখেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আজ সেঞ্চুরির ক্ষেত্রেও তাই। আমার কাছে সেঞ্চুরি কখনোই খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। যদি সেঞ্চুরিটা দলের কাজে এসে থাকে তাহলে সেঞ্চুরিটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার সেঞ্চুরির জন্য যদি আমি আস্তে আস্তে খেলতে থাকি, যা-ই হোক দলের আমি আস্তে আস্তে খেলতে থাকবো, তাহলে ওই সেঞ্চুরির কোনো দাম নেই। অনেক সময় ৫০০ বলে সেঞ্চুরি করতে হবে। অনেক সময় ৭০ বলে। ব্যাটসম্যান হিসেবে কাজ রান করা। আর সেঞ্চুরিই কেন করতে হবে? দলের প্রয়োজনে রান করা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা ৯৯ হতে পারে, ১০০ও হতে পারে, ১২০ বা ৭০ও হতে পারে। দলের প্রয়োজনে যেভাবে রান করা দরকার সেটা করতে হবে। এটা করতে গিয়ে যদি সেঞ্চুরি হয়ে যায় সেটা একটা রেকর্ড হলো, আলাপ-আলোচনা হলো ওতোটুকুই। কিন্তু ইম্প্যাক্টফুল ইনিংস খেলাটাই জরুরি।

মুশফিককে প্রথম দেখার স্মৃতি কি মনে আছে?

নাজমুল আবেদীন ফাহিম: মুশফিককে প্রথম বিকেএসপিতেই দেখেছি। ওকে আমি ভর্তি করেছিলাম। ট্রায়ালে দেখে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। আমার কাছে শুরু থেকে মনে হয়েছিল ও খুব মেধাবী ছিল। খুব ভালো সম্ভাবনা থাকবে ভবিষ্যতে। এজন্য আমরা আলোচনা করে নির্বাচন করেছিলাম।

মুশফিকের রিভার্স সুইপ নিয়ে অনেক আলোচনা। এসবের কি প্রয়োজন দেখেন?

নাজমুল আবেদীন ফাহিম: এই শটটায় ঝুঁকি থাকে। কিন্তু ক্রিকেটের বাইরে তো নয়। যেকোনো ব্যাটসম্যানের এটা মনে হয় ইচ্ছে করে খেলে না। যখন রান পাচ্ছে না উইকেটে, একটু অফফর্মে থাকে, স্বস্তিবোধ নিজের ওপর চাপ কমাতে গিয়ে এই শটটা খেলার চেষ্টা করে। তখনই এই ঝুঁকিটা নেয়। আজকে এই ঝুঁকি নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলেছে। একটুও চাপে ছিল না। নিজের স্কিলে শতভাগ বিশ্বাসী ছিল। ওর প্রয়োজন হয়নি অন্য কিছু চিন্তা করার। ঝুঁকি নিয়ে ব্যাটিং করার।

আপনার সঙ্গে যখন কাজ করেছে তখন রিভার্স সুইপ নিয়ে কি আলোচনা হয়েছে?

নাজমুল আবেদীন ফাহিম: আমাদের মধ্যে খুব বেশি আলোচনা হয়নি। কারণ, আমরা দুজনই জানি— যখন নিজের স্কিল অনুযায়ী রান করা যাবে তখন ঝুঁকি নেওয়ার কোনো মানে থাকবে না। আজ যেমন ও খুব নিরাপদ ও গোছানো ক্রিকেট খেলেছে। এই উইকেটে বাড়তি কিছুর প্রয়োজন হয়নি। ও করেও-নি কিছু। মাত্র ৪টি চার মেরেছে। তাতে তো মনে হচ্ছে কতোটা ঠাণ্ডা মাথায় ইনিংস লম্বা করেছে।