খেলাধুলা

ইতালির বিস্ময়কর ‘পতন’

সাত মাস আগেই পেয়েছিলেন জাতীয় বীরের মর্যাদা। জর্জিনহো-কিয়েল্লিনিরা উড়ছিলেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ঝরে পড়লো ডানা, ধরণীতলে ভূপাতিত হলো ইতালির ফুটবল টিম। ওয়েম্বলিতে গত বছর জুলাইয়ে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন দলই কি না বিশ্বকাপেই জায়গা করে নিতে পারলো না! বিশ্বাস হয়! চারদিকে দীর্ঘশ্বাস, প্রতিধ্বনিত হতে থাকে হাহাকার।

গত ২৪ মার্চ নিজেদের শহর পালেরমোতে এক দুঃখগাথার ভাগীদার হলো লাখো ইতালিয়ান। অবশ্য বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্লে অফ ড্র শুরুতেই মন খারাপ করে দিয়েছিল ফুটবলপ্রেমীদের। কারণ পর্তুগাল কিংবা ইতালির যে কোনও এক দলকে ছিটকে যাওয়ার পথ নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল ওই ড্রতে। প্লে অফের সেমিফাইনালে দুই দলই জিতে গেলে উঠতে হতো ফাইনালে, যেখান থেকে কেবল একটি দলই পেতো বিশ্বকাপের টিকিট। মানে হয় ইতালি নয়তো পর্তুগাল! সুঁতোয় ঝুলে থাকা দুই দলের ভাগ্য আগেভাগেই ছিড়ে যায়। প্লে অফের সেমিফাইনালে পুঁচকে নর্থ মেসিডোনিয়ার কাছে সমাধি হয় ইতালির বিশ্বকাপে ফেরার স্বপ্ন।

গোল না পেলেও মাঠজুড়ে ছিল ইতালির আধিপত্য। ৩২টি শট নিয়েছিল তারা, লক্ষ্যে ছিল ৫টি। অন্যদিকে মেসিডোনিয়ার শট চারটি। অতিরিক্ত সময়ে খেলা গড়ানোর আভাস যখন দিচ্ছিল, তখনই সেই জায়ান্ট বধের মুহূর্ত। আলেক্সান্দার ট্রাকোভস্কি বল নিয়ন্ত্রণে রেখে বক্সের বেশ বাইরে থেকে নিলেন ডান পায়ের শট, ইতালি গোলকিপার জিয়ানলুইজি দোনারুম্মা বলের গতিপথ বুঝে ডান দিকেই ঝাঁপ দিলেন। কিন্তু বল তাকে ফাঁকি দিলো, কাঁপালো জাল, নিস্তব্ধ স্বাগতিকদের গ্যালারি।

চার বছর আগেও একই কষ্ট, একই যন্ত্রণা পেতে হয়েছিল ইতালিকে। ১৯৫৮ সালের পর প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলা হয়নি। রাশিয়া বিশ্বকাপে তাদের অনুপস্থিতি সবাইকে হতবাক করেছিল। ওইবার প্লে অফে সুইডেনের কাছে ১-০তে পিছিয়ে থেকে স্বপ্ন ভেঙেছিল। যা টালমাটাল করে দিয়েছিল পুরো দলকে। আন্দ্রে বার্জাগলি, ড্যানিয়েল ডি রসসি ও অধিনায়ক জিয়ানলুইজি বুফনের মতো অভিজ্ঞরা অবসর ঘোষণা করেন। ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট কার্লো তাভেচ্চিও করেন পদত্যাগ। চার বছর আগের সেই ইতালি পুরোপুরি বদলে যায়। রবার্তো মানচিনির অধীনে পুনরুত্থান হয় আজ্জুরিদের। ইউরোর বাছাইয়ে গ্রুপের ১০ ম্যাচের সবগুলো জিতে ফিনিক্স পাখির মতো নবজাগরণের আভাস দেয় তারা। মূল পর্বেও ধারাবাহিকতা ধরে রেখে ৫৩ বছর পর প্রথম ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে ইতালি। লন্ডনে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে ফাইনালে ৩-২ গোলে টাইব্রেকারে হারিয়ে ১৯৬৮ সালের পর প্রথমবার ইউরোপিয়ান ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব ভুলিয়েদেয় বিশ্বকাপে না ওঠার দুঃখ-কষ্ট।

দারুণ টিম স্পিরিটে ইউরো জয় করে ইতালি। ছিল না কোনও চাপ। খেলোয়াড়রা নিজেদের প্রকাশে বদ্ধ পরিকর ছিল। কিন্তু সেই খেলোয়াড়রা ওই অভাবনীয় জয়ের পর থেকে আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল।

ইউরো চ্যাম্পিয়ন দলটির এমন পতন সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় বিস্ময়

ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করায় ইতালির বিশ্বকাপে ওঠা মনে করা হয়েছিল কেবলই আনুষ্ঠানিকতার। কিন্তু ওয়েম্বলিতে ঐতিহাসিক ফাইনাল জয়ের পর থেকে ছন্নছাড়া আজ্জুরিরা। পরের ম্যাচ ছিল বিশ্বকাপ বাছাই, বুলগেরিয়ার সঙ্গে ড্র করে তারা। এরপর যে সুইজারল্যান্ডকে ইউরোর গ্রুপ পর্বে সহজে হারিয়েছিল, সেই দলটির সঙ্গে দুটি ড্র করে তারা, এরপর নর্থ আয়ারল্যান্ডের সঙ্গেও ড্র। গ্রুপে সুইজারল্যান্ডের পেছনে পড়ায় খেলতে হয় প্লে অফে। সম্ভবত এই ফলগুলো তাদের মনোবলে বিরাট ধাক্কা দিয়েছিল, যার খেসারত দিতে হয়েছে মেসিডোনিয়ার কাছে হেরে।

এই অপ্রত্যাশিত পরাজয় স্তম্ভিত করে দেয় ইতালির গণমাধ্যমগুলোকে। ‘তুত্তোস্পোর্ত’র লিডে শিরোনাম ছিল, ‘নাআআআআ’। উপরে গোলকিপার জিয়ানলুইজি দোনারুম্মাকে জর্জিও কিয়েল্লিনির সান্ত্বনা দেওয়ার ছবি। আরেক সংবাদপত্র ‘গাজেত্তা দেল্লো স্পোর্ত’ একই ছবি লিড করে শিরোনাম দিয়েছিল, ‘এই জগতের বাইরে’। তারা কোচ মানচিনিকে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবি করেছে। কোরিয়ের দেল্লো স্পোর্ত-এর প্রথম পাতায় ছবি-চেলসি তারকা জর্জিনিয়ো তার জার্সি দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন, পাশে দোনারুম্মা। শিরোনামে লেখা, ‘নরকে’। এই পত্রিকাটি ‘হতবাক করা বিদায়’ ও মানচিনির ‘বিরাট হতাশার’ কথা তুলে ধরেছে।

ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের শ্রেষ্ঠত্ব একপাশে সরিয়ে রাখলে মেসিডোনিয়ার কাছে হারের আগে একটি পরিসংখ্যান ইতালির দৈন্যদশা আরো ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে যথেষ্ট। ইতালির শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ ছিল ২০১৪ সালের ১৫ জুন। ২৮৩৯ দিন আগে গ্রুপের সেই ম্যাচটিতে তারা খেলেছিল ইংল্যান্ডের সঙ্গে। তাদের শেষ বিশ্বকাপ নকআউট ম্যাচ ছিল ২০০৬ সালের ৯ জুলাই। ৫৭৩৭ দিন আগের ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে। 

সেবার চতুর্থ ট্রফি জেতার পর দুটি বিশ্বকাপ খেলে গ্রুপ পর্বের বাধা পেরোতে পারেনি ইতালি। এবার ৬৭তম র্যাংকিংয়ের দলের কাছে হেরে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপেই খেলা হলো না তাদের। দলটির অধিনায়ক জর্জিও কিয়েল্লিনি বলেন, ‘বিরাট একটি শূন্যতা আমাদের হৃদয়ে থেকে যাবে। একটা ব্যাপার পরিষ্কার, আমরা বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত। আমরা আশাবাদী ব্যর্থতা আমাদের আবারও নতুন করে শুরু করতে সাহায্য করবে।’ এই বিপর্যয়ের সাক্ষী মিডফিল্ডার জর্জিনহো বলেন, ‘এটা বিরাট হতাশাজনক। কষ্ট দিচ্ছে, অনেক বেশি কষ্ট দিচ্ছে।’

ইতালির এই কষ্টের ভাগীদার ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো। সুইজারল্যান্ডে জন্ম নিলেও ইতালির ভক্ত তিনি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর থেকে ইতালিকে বিশ্বকাপে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার, ‘কান্না চলে আসছে। সব ইতালিয়ানদের জন্য এটা কষ্টের। টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে আজ্জুরিদের ছাড়া। পরের বিশ্বকাপে যদি তারা যেতে পারে, তাহলেও তাদের অনুপস্থিতির সময়টা হবে ১২ বছরের। ইতালিয়ান শিশুদের জন্য দুঃখজনক এটি। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। কারণ মাত্র ৩২ দল খেলতে পারবে এবং বিশ্বকাপ হয় চার বছর পরপর।’

ইংল্যান্ডের ফুটবল কিংবদন্তি গ্যারি লিনেকার যেমনটা বলেছেন, ‘ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হওয়া থেকে শুরু করে বিশ্বকাপে না ওঠা, এটা একটা খুবই শক্তিশালী ও বিপর্যয়কর পতন।’

সত্যিই তাই, ইউরো চ্যাম্পিয়ন দলটির এমন পতন সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় বিস্ময়।