খেলাধুলা

শিহরণ জাগানো জয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা, বিশ্ব সেরা মেসি

ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়া উগো লরিসের নাগালের বাইরে দিয়ে জড়ালো বল। গনজালো মনতিয়েল যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। জার্সি টেনে মুখ ঢেকে কান্না লুকাতে চাইলেন। প্রায়শ্চিত্ত করলেন তার কারণে ফ্রান্সের সমতা ফেরানো গোলে। হ্যান্ডবল করেছিলেন তিনি। তাতে লিওনেল মেসির আজীবনের স্বপ্ন যে ভেঙেচুরে যেতে বসেছিল। ওই গোলেই পূরণ হলো তাদের অধিনায়কের আজীবন লালিত স্বপ্নের। উল্লাসে মাতলো গোটা লুসাইল স্টেডিয়াম। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন যে আর্জেন্টিনা! বিশ্ব সেরা মেসি। এমন শিহরণ জাগানো ম্যাচে ভাগ্যদেবী তার একমাত্র আক্ষেপ পূরণ করে দিলেন।

এই দিনটার জন্য কেটেছে কত বিনিদ্র রজনী। অগণিত শিরোপা আর রেকর্ড পায়ে লুটিয়ে পড়লেও বুকের মধ্যে ছিল দীর্ঘশ্বাস। অপূর্ণতার বেদনা। খুব কাছে গিয়েও না পাওয়ার যন্ত্রণায় বুক বিদীর্ণ হয়েছিল ব্রাজিলে। তবে আশা হারাননি। স্বপ্ন দেখছিলেন, ছিলেন অপেক্ষায়। অবশেষে ফুটবল জাদুকরের জীবনে এলো পূর্ণতা। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে একমাত্র খাদ থাকা বিশ্বকাপ ট্রফি নিলেন হাতে। লিওনেল মেসি হলেন সর্বকালের সেরা ফুটবলার।

১৯৮৬ সালে ডিয়েগো ম্যারাডোনা একাই জিতিয়েছিলেন আর্জেন্টিনাকে। তার অধিনায়কত্বে দ্বিতীয়বার হয়েছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। হয়েছিলেন কিংবদন্তি। তারপর তার জায়গা নিতে পারেননি কেউই। হয়তো কখনও নিতে পারবেন না কেউ। কিন্তু মেসি যখন এলেন, জাদু দেখিয়ে আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে তার নাম। যদিও বিশ্বকাপের ট্রফি তার হাতে ছিল না বলে ঠিক জমছিল না কে সেরা, সেই বিতর্কে। তারই ইতি টানলেন মধুর সমাপ্তিতে।

সেমিফাইনাল জিতে ফাইনালে ওঠার পরই বিশ্বকাপ অধ্যায়ের ইতি টানার ঘোষণা দেন মেসি। সেটাই যেন আরও তাতিয়ে দেয় মলিনা-মার্তিনেজদের। কোমর বেধে মেসির শেষ বিদায়টা রাঙাতে নামে লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে।

১১ জনই ছিলেন যুদ্ধাংদেহী। একের পর এক বল নিয়ে বক্সে ঢুকে রদ্রিগো ডি পল, অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া ও ম্যাক অ্যালিস্টার মুহুর্মুহু আক্রমণ চালাতে থাকেন। তাতে তটস্থ ফ্রান্সের ১১ যোদ্ধা। পুরো মাঠ জুড়ে ছিলেন মেসির সেনারা। ফরাসি কোনও খেলোয়াড়কেই বল পায়ে রাখতে দেননি। বল যেখানে সেখানেই ছিলেন মেসি থেকে শুরু করে ওটামেন্ডিরা।

কাউন্টার অ্যাটাকে ক্লান্ত ফ্রান্স পিছিয়ে পড়ে অসাবধনাতবশত। ডি মারিয়াকে ফাউল করেন উসমান দেম্বেলে। দ্বিতীয়বার না ভেবে পেনাল্টির বাঁশি বাজান পোল্যান্ডের রেফারি সাইমন মার্সিনিয়াক। ইতিহাস গড়ার সুযোগ গ্রহণ করেন মেসি। উগো লরিসকে ভুল দিকে পাঠিয়ে ডানপাশ দিয়ে জাল কাঁপান তিনি। লুসাইলও কেঁপে ওঠে প্রায় ৪০ হাজার দর্শকের গগনবিদারী উল্লাসে।

ওই এক গোলে মেসি গড়েন একাধিক ইতিহাস। বিশ্বকাপে রেকর্ড ২৬তম ম্যাচ খেলতে নেমে এই আসরের ষষ্ঠ গোল করে গোল্ডেন বুটের দৌড়ে এগিয়ে যান। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপে ১২ গোল ও ৮ অ্যাসিস্ট। ১৯৬৬ সালে এই রেকর্ড তালিকাভুক্ত করার পর থেকে বিশ্বকাপে কোনও খেলোয়াড় সর্বোচ্চ ২০ গোলে অবদান রাখলেন। এছাড়া প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে গোলের কীর্তি গড়লেন সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী।

গোল দিয়ে যেন আরও চেপে বসে আর্জেন্টিনা। খুঁজেই পাওয়া যায়নি কিলিয়ান এমবাপ্পেদের। বরং আবারও বলের দখল হারিয়ে ৩৬ মিনিটে গোল খেয়ে বসে ফ্রান্স। মাঝমাঠ থেকে মেসি বাঁ পায়ের জাদুতে বল তুলে পাঠান দৌড়াতে থাকা ম্যাক অ্যালিস্টারের দিকে। তিনিও বল টেনে বক্সের মধ্যে ঢোকেন, তারপর বাঁ প্রান্তে ডি মারিয়াকে বল বাড়ান। তিনি ভুল করেননি। নিখুঁত শটে লরিসকে পরাস্ত করেন ডি মারিয়া। এনিয়ে তিনটি বিশ্বকাপেই গোল করলেন তিনি এবং সবগুলোই নকআউট পর্বে।

দলে বদল আনতে বাধ্য হন দিদিয়ের দেশম। দেম্বেলের বদলে কোলো মুয়ানি ও জিরুদকে উঠিয়ে থুরামকে নামান। কিন্তু দৃশ্যপট পাল্টাতে পারেনি ফ্রান্স।

দ্বিতীয়ার্ধে আক্রমণের ধার কিছুটা কমলেও আর্জেন্টিনা ফরাসিদের বক্সে ব্যস্ত থাকে। বিরতির পর ডি পলের ভলি সরাসরি লরিসের কাছে যায়। জুলিয়ান আলভারেজের শটও দারুণ সেভে আটকান ফ্রান্সের অধিনায়ক।

শেষ ১০ মিনিটে হুট করে ঘুরে যায় ম্যাচ। ৭৯ মিনিটে মুয়ানিকে বক্সের মধ্যে ফাউল করেন ওটামেন্ডি। পেনাল্টি নেন এমবাপ্পে। বাঁ পাশ দিয়ে শট নেন, এমিলিয়ানো মার্তিনেজও ঝাঁপ দেন বলের দিকেই। তার হাত ছুঁয়ে জালে জড়ায় বল। পরের মিনিটেই আরেকটি গোল। কোম্যান বল দখলে নিয়ে বাঁ দিকে বল বাড়িয়ে দেন। এমবাপ্পে থুরামকে বল দেন এবং ফিরতি পাস থেকে দারুণ ভলিতে ২-২ এ সমতা ফেরান। ৯৭ সেকেন্ডের মধ্যে দুটি গোল করেন তিনি।

দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে কামাভিঙ্গা ও কোলো মুয়ানি অল্পের জন্য পারেননি ফ্রান্সকে এগিয়ে দিতে। সপ্তম মিনিটে মেসির দুর্দান্ত শট সেভ করে বারের ওপর দিয়ে পাঠান লরিস।

ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ১০৩ মিনিটে আলভারেজের বদলে লাউতারো মার্তিনেজ ও ডি পলের জায়গায় লিসান্দ্রো পারেদেসকে নামান স্কালোনি। মেসি বল ঠেলে দেন মার্তিনেজকে, তার শট স্লাইড করেন উপামেকানো। বাউন্স করে আসা বল ভলি করেন, ভারানে হেড করে তাকে আটকান।

পরের মিনিটে উপামেকানো আলতো ছোঁয়ায় মার্তিনেজের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করেন, গোলবারের পাশ দিয়ে বল চলে যায়। ১০৮ মিনিটে মার্তিনেজের শট গোলমুখ থেকে ঠেকান লরিস, কিন্তু ফিরতি শটে কাছের পোস্ট থেকে গোল করেন মেসি। বেশিক্ষণ লিড আবারও ধরে রাখতে পারেনি আর্জেন্টিনা। আবারও এমবাপ্পে। মনতিয়েল কোম্যানের শট বক্সের মধ্যে হ্যান্ডবল হলে পেনাল্টি থেকে গোলে হ্যাটট্রিক করেন তিনি।

স্কোর ৩-৩ থাকায় ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। এমবাপ্পে আবারও মার্তিনেজকে পরাস্ত করেন। কিন্তু  মেসিও গোল পান। কিংসলে কোম্যানের শট ঠেকিয়ে মার্তিনেজ হয়ে যান ম্যাচের নায়ক। পাওলো দিবালার শক্তিশালী শট জাল কাঁপায়। এরপর শুয়ামেনি গোলবারের পাশ দিয়ে মারলে উল্লাসে ফেটে পড়ে আর্জেন্টিনা। লিয়ান্দ্রো পারেদেস গোল করে স্বস্তি ফেরান তাদের ক্যাম্পে। র‌্যান্ডাল কোলো মুয়ানি করেন ফ্রান্সের দ্বিতীয় গোল। মনতিয়েলকেই পাঠানো হয় চতুর্থ শট নিতে, লরিসের ডানপাশ দিয়ে জাল কাঁপান তিনি। প্রায়শ্চিত্ত করেন হ্যান্ডবলের। টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে জেতে আর্জেন্টিনা। ৩৬ বছরের শিরোপা খরা ঘুচলো, মেসিকে নিয়ে বিতর্কেরও হলো অবসান।

পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে ছিল মেসির পদচারণা। ফাইনালেও রেখেছেন দুর্দান্ত ছাপ। করেছেন জোড়া গোল। ৭ গোল ও তিন অ্যাসিস্টে গোল্ডেন বুটটা হয়তো জিততে পারেননি। তবে বিশ্বকাপ ট্রফিটা দিয়ে ফুটবল শোধ করলো তার ঋণ।