খেলাধুলা

‘ক্রিকেটীয় মেধার পরিচর্যায় সফল সাকিব’

পারফরম্যান্স আরো ক্ষুরধার। ব্যাটিংয়ে আগ্রাসন বাড়িয়ে হয়েছেন ভয়ঙ্কর। মাঠে নামলেই প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলার তীব্রতা কাজ করছে প্রতিনিয়ত। বোলিংটাও আঁটসাঁট। সঙ্গে নেতৃত্বগুণে অনন্য। বিপিএলের সাকিব আল হাসানের সফরে যে কেউই হবেন মুগ্ধ।

ফরচুন বরিশালের অধিনায়ক নিজের পারফরম্যান্সে হুট করেই পরিবর্তন আনেননি। নিজের খেলা একধাপ এগিয়ে নিতে কাজ করছেন। যে কাজে তাকে সাহায্য করছেন ভারতের পারফরম্যান্স অ্যানালিস্ট লক্ষ্মী নারায়ণ। সাকিবের নিজের আগ্রহে বরিশাল নিয়োগ দিয়েছে এই অ্যানালিস্টকে। 

লক্ষ্মী নারায়ণ চেন্নাই সুপার কিংসের পারফরম্যান্স অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করে খ্যাতি পেয়েছেন। মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে ৮ বছর কাজ করার পর ২ বছর ছিলেন গুজরাট লায়ন্সে। কাজ করেছেন বিসিসিআইয়ের সঙ্গেও। ২০০৮ সালে ভারত অনূর্ধ্ব -১৯ দলের সঙ্গে ছিলেন। যে দলে খেলেছিলেন বিরাট কোহলি, রবীন্দ্র জাদেজার মতো তরুণ ক্রিকেটাররা।

বিপিএলে দ্বিতীয়বার কাজ করতে এসেছেন লক্ষ্মী। এর আগে ছিলেন কুমিল্লার শিবিরে। কীভাবে সাকিবের সঙ্গে গড়ে উঠেছে লক্ষ্মীর রসায়ন। কীভাবে কাজ করছেন দুজন, রাইজিংবিডির প্রতিবেদক ইয়াসিন হাসানের সাক্ষাৎকারে উঠে এলো সব-

বরিশালের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন?

লক্ষ্মী নারায়ণ: সাকিব আল হাসানের সঙ্গে আমার আগে থেকে পরিচয় ছিল। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ও আমাকে কল দিয়ে এখানে কাজ করার কথা বললো। আমার সুযোগ ছিল। এর আগে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে এক মৌসুম কাজ করেছি। এখন বরিশালের হয়ে। কাজ করে বেশ আনন্দ পাচ্ছি। দলটাও বেশ ভালো। তরুণ ও সিনিয়র ক্রিকেটারদের মিশ্রণে বেশ ভালো দল। 

সাকিবের সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে হয়েছিল, মনে আছে?

লক্ষ্মী নারায়ণ: আসলে সাকিবের সঙ্গে এর আগে আমার কোনো আলাপই হয়নি। জানাশোনা ছিল। ও আমার সম্পর্কে জানতো। সাকিবকে আমার না চেনার কোনো কারণই নেই। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলো, এখানে কাজ করার প্রস্তাব দিল। আমি রাজি হয়ে যাই। এখানে আমাদের রোজ কথা হচ্ছে। দুজনের সম্পর্কটাও জমাট হচ্ছে। 

আপনার চোখে বরিশাল মাঠে কেমন পারফর্ম করছে, যদিও পাঁচ ম‌্যাচে চার জয়ই বলে দিচ্ছে দলের সার্বিক চিত্র…

লক্ষ্মী নারায়ণ: এখন পর্যন্ত আমরা বেশ ছন্দে আছি। প্রথম ম‌্যাচ হারের পর আমরা ধারাবাহিকভাবে জিতছি। সেটা খুবই তৃপ্তিদায়ক। সঙ্গে সাকিবের পারফরম‌্যান্স যোগ করতে চাই। অসাধারণ। নিজে রান করছে, উইকেট পাচ্ছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে। তিনে মিশে একাকার। বাকি ব‌্যাটসম‌্যানরা রান পাচ্ছে। বোলাররা উইকেট পাচ্ছে। 

তবে এটা লম্বা প্রতিযোগিতা। ছন্দ ধরে রাখতে না পারলে হারিয়ে যেতে পারেন যে কোনো সময়। সামনের ম‌্যাচগুলোতে যদি আমরা একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারি তাহলে ভালো কিছু হবে। বরিশাল শেষ আসরে রানার্সআপ হয়েছিল। এবার নিশ্চয়ই শিরোপা জিততে চাইবে। 

সাকিবের বয়স বাড়ছে। পারফরম‌্যান্সও বাড়ছে। একটু বলবেন ফি বছর তার পারফরম‌্যান্স বাড়ার রহস‌্য কী?

লক্ষ্মী নারায়ণ: ব‌্যাটিং-বোলিংয়ের থেকেও সাকিব নিজের ক্রিকেটীয় মেধার পরিচর্যা করে। যেটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চলার পথ মসৃণ করে দেয়। নিজের বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা করে। সফল হবে কি হবে না সেসব ভেবে নিজের লক্ষ‌্য স্থির করে না। এখন বিপিএলে ভালো করছে। এর আগে জাতীয় দলের হয়ে তার পারফরম‌্যান্স ভালো ছিল। জাতীয় দলের দুই ফরম‌্যাটের অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশও ভালো করছে।

দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সাকিব আপনার সঙ্গে কী নিয়ে কাজ করছেন? কী জানতে চাচ্ছেন? তার অ‌্যাপ্রোচ কী?

লক্ষ্মী নারায়ণ: আমরা প্রতি ম‌্যাচে একটা পরিকল্পনা করে আসছি। ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা থাকছে। নিজেদের শক্তি ও পরিকল্পনায় আমরা স্থির থাকছি। একটা বিষয়, সাকিব আগের থেকে বেশি আক্রমণে যেতে চাচ্ছে। ন্যূনতম ঝুঁকি নিয়ে সেটা কীভাবে সম্ভব, সেই পথ আমরা খুঁজে বের করেছি। প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে পারলেই জয় চলে আসে। এখন পর্যন্ত যা হচ্ছে সবটাই পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়ার অংশ। 

আপনার কাজটা খুব বিশেষ। একটু বলবেন, বরিশালের খেলোয়াড়রা আপনার কাছে এসে কী জানতে চায়?

লক্ষ্মী নারায়ণ: তরুণ ক্রিকেটারদের মধ‌্যে কথা বলার জড়তা কাজ করে। তবে সিনিয়র ক্রিকেটাররা ঠিকই নিজেদের কাজ আদায় করে নেয়। আমি তরুণদের জানাতে বেশ আগ্রহী থাকি। ওদের কাছে গিয়ে কথা বলতে পছন্দ করি। এর আগে বিজয়, সাইফউদ্দিনদের সঙ্গে কাজ করেছি। মিরাজ, রাব্বীদের এবার পেয়েছি। তাদেরকে জানানোর চেষ্টা করি তাদের কোথায়, কী নিয়ে কাজ করতে হবে।

আমার তথ‌্য, আমার যুক্তি, আমার অভিজ্ঞতা তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে উন্নতি করাতে চাই। ধীরে ধীরে তারাও বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করছে। এটা এমন একটা প্রক্রিয়া, একধাপ উন্নতি করলেই আপনার মনে হবে অনেক কিছু পাল্টে গেলো।

ক্রিকেটীয় স্কিলের সঙ্গে অ‌্যানালেটিকাল তথ‌্যগুলো বোঝার চেষ্টা করছে তারা। সেভাবে নিজেদের পরিকল্পনা সাজানোর চেষ্টা করছে। নিজে কীভাবে ব‌্যাটিং করবে, প্রতিপক্ষকে কেমন করে সামলাবে, নিজের শক্তির জায়গা, প্রতিপক্ষের দুর্বল জায়গাগুলো বোঝার চেষ্টা করছে। বোলাররা বুঝতে চেষ্টা করছে কার ইয়র্কারে দুর্বলতা, কার স্লোয়ারে দুর্বলতা। কে অফসাইডে ভালো। কে সোজা ব‌্যাটে ভালো খেলে। এগুলো পুরোটাই তথ‌্য নির্ভর কাজ। আপনি যত সময় দেবেন তত আপনার মাথা খুলবে। রাতারাতি সফল হওয়ার সম্ভবনা নেই কিন্তু।  

তারা ধীরেধীরে শেখার আগ্রহ দেখাচ্ছে । জানতে চাচ্ছে। এটা শুধু বিপিএলেই নয়, তাদের পরবর্তী ক্রিকেট ক‌্যারিয়ারেও বেশ কাজে লাগবে। আমার কাজ ক্রিকেটারদের উন্নতিতে লাগাতে চাই। তাদের ক্রিকেটীয় স্কিলে যদি ৫-১০ শতাংশ উন্নতি হয় তাহলেই যথেষ্ট।     ক্রিকেটে প্রযুক্তির ব‌্যবহার বাড়ছে। আপনিও এটা নিয়েই কাজ করছেন। এতে কি সত‌্যিই তাদের উপকার হয়?

লক্ষ্মী নারায়ণ: নিশ্চিতভাবেই প্রযুক্তি ক্রিকেটারদের উপকার করছে। অ‌্যানালেটিকাল দিক নিয়ে আমি ১৫-১৬ বছর কাজ করছি। আমরা কীভাবে প্রযুক্তির সঠিক ব‌্যবহার করে ক্রিকেটারদের উপকৃত করতে পারি, তাদের পারফরম‌্যান্সে উন্নতি করতে পারি সেটা মূল বিষয়। আমি নিজেও ক্রিকেট খেলেছি। বুঝতে পারি কোথায় ঘাটতি আছে, তা বের করে আনাটাই গুরুত্বপূর্ণ। 

আপনি অতি ক্ষুদ্র বিষয়গুলো এখান থেকে বের করে আনতে পারবেন। আগেও বলেছি ৫-১০ শতাংশ উন্নতি যদি প্রযুক্তি দিয়ে করা যায় তাহলে আপনি কয়েকধাপ এগিয়ে যাবেন। আপনাকে আপনার উন্নতির ম‌্যাপ নিজের তৈরি করতে হবে। সেই উন্নতির পথে কী কী করার প্রয়োজন সেটা ঠিক করে দেবো আমরা। বাকিটা স্কিলের ওপর নির্ভর করবে। আপনি যেখানে আটকে যাবেন সেখানেই আমরা থাকবো।  

ধরুন কোনো ক্রিকেটার আগ্রাসন দেখাতে পছন্দ করেন। কিন্তু বহু চেষ্টায় সফল হতে পারছে না। আমরা তার খুঁটিনাটি বের করে বুঝিয়ে দেবো কোথায় সমস‌্যা হচ্ছে, কেন পারছে না। কোথায় উন্নতি করতে হবে। সে ডানহাতি বোলারদের বিপক্ষে বেশি সফল নাকি বাঁহাতি বোলারদের। স্পিনারদের বিপক্ষে সাবলীল নাকি পেসারদের। পাওয়ার প্লে’তে ভালো নাকি লেট অর্ডারে। খোলাখুলিভাবে তার ভাবনা চিন্তার রসায়নের সঙ্গে ব‌্যাট-বলের মধুর সম্পর্ক গড়ে দেবো। 

সামনেই তিনি আইপিএল খেলতে যাবেন। নিশ্চয়ই কথা হচ্ছে দুজনের?

লক্ষ্মী নারায়ণ: আইপিএল নিয়ে কোনো প্রশ্ন নয়। 

সাকিব বাদে আর কোনো বাংলাদেশের ক্রিকেটারকে অনুসরণ করেন?

লক্ষ্মী নারায়ণ: হ্যাঁ, কুমিল্লায় থাকার সময় স্থানীয় সব ক্রিকেটারকে নিয়ে কাজ করেছিলাম। তামিম, সাইফউদ্দিন, বিজয় সেবার আমাদের হয়ে খেলেছিল। এবার বিজয় আছে, মিরাজ, মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে কাজ করছি। তারা প্রত‌্যেকেই ভালো। অ‌্যানালিস্ট হিসেবে আমার কাজই প্রত্যেক ক্রিকেটারকে জানা, তাদের নিয়ে কাজ করা, তাদের প্রতিটি ম‌্যাচ দেখা, তাদেরকে মূল‌্যায়ন করে খেলাটাকে এগিয়ে নেওয়া।