নেছার উদ্দিন : একটি ধ্রুপদি লড়াইয়ের অপেক্ষা। স্বপ্নের ফাইনাল। মুখোমুখি দুই পরাশক্তি জার্মানি ও আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপের এই ম্যাচটিই নির্ধারণ করে দেবে শিরোপা। এক দল হাসবে শেষ হাসি? আর অন্য দল চোখের জলে বিদায় নেবে।
ম্যাচটি মাঠে গড়াবে বাংলাদেশ সময় রাত ১টায়। সরাসরি সম্প্রচার করবে বিটিভি, মাছরাঙা ও গাজী টিভি।ফুটবল বিশ্বে থাকবে দুই ধরনের অনুভূতি। ম্যাচ শেষে কেউ দুষবেন রেফারিকে। আর কেউ বা ভাগ্যকে। জয়ী দলের পতাকা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল হবে। অন্যদিকে পরাজিত দলের ওপর বসবে ক্ষোভের মেলা। যে মেলা থেকে ভক্তরা ছড়িয়ে পড়েন দাঙ্গায়। ভবের মাঝে এটাই ফুটবলের লীলা-খেলা। দীর্ঘ ২৪ বছর পর ফাইনালে পা রেখেছে আর্জেন্টিনা। তাই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ব্রাজিলে জমায়েত হচ্ছে হাজারো আর্জেন্টিনার সমর্থক। তাদের দরকার নিরাপত্তাও। আজ ফাইনালের আগে আরো ভীড় জমাতে পারে মারাকানা স্টেডিয়ামে। সেখানে তাদের আসার উদ্দেশ্য একটাই; মেসিদের বিশ্বকাপ চাই! সমর্থকদের নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন করা হয়েছে ২৬ হাজার পুলিশ ও সেনা।অপরদিকে, এক যুগের পর ফাইনালে উঠেছে জার্মানি। শিরোপা জয়ের ক্ষুধা তাদেরও কম নয়। তবে সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে জার্মানি। স্বাগতিকদের আক্রোশের মুখে পড়তে হতে পারে তারা। তাই জার্মানদের জন্যও থাকছে বাড়তি নিরাপত্তা।দীর্ঘ ৬৪ বছর পর ব্রাজিলের ঐতিহাসিক মারাকানা স্টেডিয়ামে গড়াচ্ছে বিশ্বকাপের ফাইনাল। ম্যাচটি আয়োজনের জন্য রিও ডি জেনিরোতে চলছে সাজ সাজ রব। বিশ্বকাপের আগে যেভাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগেছিল, আসর চলাকালে সেটা চোখে পড়েনি। তাই আগের মতো ফাইনালেও পাস করতে চাইবে স্বাগতিকরা।
দুই দল এ পর্যন্ত ছয়বার বিশ্বকাপে মুখোমুখি হয়েছে। তার মধ্যে জার্মানি জিতেছে তিনবার। আর্জেন্টিনা জিতেছে একবার। বাকি দুটি ম্যাচ ড্র হয়েছে। ২০০৬ বিশ্বকাপে টাইব্রেকারে এবং ২০১০ বিশ্বকাপে ৪-০ গোলে আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছে জার্মানি। বিশ্বকাপ কি দেখতে পাচ্ছেন মেসি? চিরশত্রুর দেশে ফাইনাল। ব্যাপারটা একটু অন্যরকম তো হবেই। জার্মানির বিপক্ষে ফাইনাল। মাঠে নামার আগে বাড়তি সতর্কতা তাদের থাকছেই।বিশ্বকাপের প্রথম দিকে আর্জেন্টিনাকে অনেকেই দুর্বল ভেবেছেন। তাদের রক্ষণ নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু মাসচেরানো-জাবালেতা-ফার্নান্দেসরা প্রমাণ করেছেন, বিশ্বকাপে তারাও কম যান না। তবে টুর্নামেন্ট যতই এগিয়েছে, ততই যেন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে আর্জেন্টিনা। প্রতিপক্ষকে দুমড়েমুচড়ে না দিলেও ভালো খেলাই ছিল তাদের সাফল্যের মূলমন্ত্র। সেমিফাইনালে তো হল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলকে টাইব্রেকারে হারিয়েছেন মেসিরা। তবে ফাইনালের আগে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে খোঁচা দিতেও ভুল করলেন না আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার পাবলো জাবালেতা, ‘এই দেশে (ব্রাজিল) ফাইনাল খেলা বড় ব্যাপার। বিশ্বকাপের শুরু থেকেই ব্রাজিলের মানুষ আমাদের বিপক্ষে গলা ফাটিয়েছে। চারপাশে এ রকম হতে থাকলে মাঝেমধ্যে নিজেদের সেরা খেলাটাই বেরিয়ে আসে। সেটাই করে দেখাচ্ছে আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা। প্রথমে কেউ পাত্তা দেয়নি আমাদের। আমরা যা খেলেছি, তাতে গর্বিত। মানুষ মনে রাখবে।’ পাশাপাশি আর্জেন্টিনার সমর্থকদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জাবালেতা বলেন, ‘আমার দেশ ফুটবল ভালোবাসে। আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠেছে বলে এমনও হয়েছে যে, দেশের অনেকে গাড়ি বিক্রি করে এখানে এসেছে। তারা হয়তো টিকিট পায়নি, কিন্তু আমাদের সমর্থন জানাতে পৌঁছে গিয়েছে। এসব ভাবলে নিজেকে আর্জেন্টাইন হিসাবে গর্ব লাগে।’জার্মানির বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচের আগে আর্জেন্টাইন এই ডিফেন্ডার বলেন, ‘ম্যাচটা কঠিন হবে জানি। তবে জেতার জন্য যা যা দরকার, কোনো কিছুর ত্রুটি রাখব না।’
ফাইনালের আগে জার্মানি ফেভারিট হলেও, আর্জেন্টিনাকেও পিছিয়ে রাখছেন না বিশেষজ্ঞরা। ফ্রান্সের লিজারাজু যেমন বলে দিলেন, ‘আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগ দুর্দান্ত। তাই জার্মান রক্ষণকে চাপে পড়তেই হবে। কিন্তু আর্জেন্টিনার যে ব্যাপারটা আমার সব থেকে ভাল লেগেছে।’
১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনা যাদুতে বিশ্বকাপের ফাইনালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়েছিল আর্জেন্টিনা। ৪ বছর পর জার্মানিও নিয়েছিল প্রতিশোধ। সেই ম্যাচে ম্যারাডোনার রেফারি বিতর্ক নিয়ে অভিমান হয়তো আজো অনেকের মনে আছে। পরবর্তীতে শিরোপা বঞ্চনার কান্না কে দেখে? ৮৬-এর নায়ক ব্রাজিল বিশ্বকাপ নিয়ে কথা বলবেন না তা কি করে হয়? তিনি মনে করেন জার্মানরা হারবে তাদের ‘ইগো’র কারণে, ‘জার্মানদের বড় ইগো সমস্যা রয়েছে। যার জন্য অর্জেন্টিনা বাড়তি সুবিধা পেতে পারে। আশা করছি, মেসিরা ফাইনালে চমক দেখাবে। শিরোপা নিয়েই ঘরে ফিরবে।’এদিকে, মেসিকে আটকাতে কৌশল আটছেন জার্মানি কোচ জোয়াকিম লো। তিনি হয়তো বোঝেন মেসি কি পারে? তাই একটাই প্রশ্ন, লিওনেল মেসিকে আটকাতে লো কোন স্ট্র্যাটেজি নিতে পারেন ফাইনালে? ঘুরেফিরে আসছে জার্মানির ডিফেন্ডার চতুষ্টয়। মেসিকে আটকাতে নেদারল্যান্ডস নাকি ছয়জন ডিফেন্ডার ব্যবহার করেছিল। জার্মানি অবশ্য এ পথে হাটেনি কখনো। তবে ছয়জন রক্ষণভাগের পাহাড়ায় থাকছেন চার ডিফেন্ডার, বোয়েটায়ং-হুমেলস-লাম-হাওয়েডস।
বাকিরা মাঝমাঠ ও আক্রমণভাগের দায়িত্বে থাকবেন। জার্মানি অবশ্য নেদারল্যান্ডসের তুলনায় সব বিভাগেই শক্তিশালী। তবে জার্মানি কোচ ভিন্ন কৌশলও অবলম্বন করতে পারেন। মেসিকে থামাতে দলের অভিজ্ঞ খেলোয়াড় শোয়েনস্টাইগারকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন তিনি।
মেসির খেলার ধরনটা হলো এমন; ডানপ্রান্তে সরে গেলে বাঁ-পায়ে আউটসাইড স্কোয়ার ডজ করে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। মাঝেমধ্যে উল্টোটাও করে বাঁ দিকে গিয়ে। যে প্রান্তেই মেসি যাক, সেই প্রান্তে তাকে ধরতে ছুটে আসবেন জার্মানির একজন ডিফেন্ডার ও সাইড ব্যাক।
শুধু মেসিকে নিয়েই নয়, আক্রমণভাগে হিগুয়েন-আগুয়েরো-লাভিজ্জিকে নিয়েও ভাবতে হবে জার্মানিকে। কেননা তাদের দিনেও জার্মানির মতো দলকে হারাতে পারেন। ইনজুরি কাটিয়ে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া ফাইনালে খেলতে পারলে আর্জেন্টাইনদের আক্রমণভাগ আরো শক্ত হবে।
জার্মানিকে টেক্কা দেওয়া তাদের জন্য আরো সহজও হবে। সাবেলা হয়তো ডি মারিয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। কোচ হিসেবে নিজের বিদায়ী ম্যাচটি চিরস্মরণীয় করে রাখতে কৌশলে কোনো ফাকফোকর রাখবেন না সাবেলাও। বিশ্বকাপের ফাইনালে মারাকানা স্টেডিয়ামে মাথা উচু করেই বিদায় নিবেন সাবেলা; এটাই চাইবেন আর্জেন্টাইন সমর্থকরা।
তা ছাড়া ফুটবল ঈশ্বরের দেশে জন্ম নেওয়া লিওনেল মেসির হাতেই বোধ হয় বিশ্বকাপের শিরোপা ভালো মানাবে। নেইমারও চাইছেন সেটাই, ‘আমি পারিনি, আমার দেশ পারেনি। তাহলে বিশ্বকাপ মেসিই জিতুক।’
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ জুলাই ২০১৪/নেছার/শামসুল