ভ্রমণ

শৈশবের সেই বৈশাখী মেলা

জাহাঙ্গীর আলম বকুল : আমি বেড়ে উঠেছি গ্রামে। একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায়। আলো ঝলমলে শহর থেকে অনেকগুলো গ্রাম পেরিয়ে, মাঠ ছাড়িয়ে, কাঁচা-পাকা রাস্তা মাড়িয়ে সেই গ্রামে যেতে হয়।

 

শৈশব ও কৈশোরের সেই গ্রামে তখন কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়নি। যন্ত্রচালিত যানের মধ্যে কালেভদ্রে দু-একটি মোটরসাইকেল দেখা যেত। গ্রামবাসী বিদ্যুতের আলো দেখতে পেত কখনো-সখনো শহরে গেলে। যানবাহন বলতে সাইকেল, ভ্যান আর গরুর গাড়ি। কৃষকেরা খেত থেকে গরুর গাড়িতে ফসল বোঝায় করে বাড়ি আনত। দাদা-চাচাদের দেখতাম ২০-২৫ কিলোমিটার দূরের জেলা শহরে যেতে ভোরে উঠে হাঁটা শুরু করতেন। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে অর্থের জৌলুস, চাকচিক্য ছিল না, তবে হৃদয়ের বন্ধন তারা পরস্পরের মধ্যে অনুভব করত।

 

তখন প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়িতে গরু, গরুর গাড়ি এবং লাঙল থাকতেই হতো। দাদাকে দেখতাম জমিতে চাষ দেওয়ার মৌসুমে গ্রামের তার সমবয়সী কয়েকজন কৃষককে ‘বেগার’ নিত। এতে চার-পাঁচটি, কখনো আরো বেশি লাঙল একসঙ্গে একটি জমিতে চাষ দিত। একটা উত্সব উত্সব ভাব বিরাজ করত। আমরা যারা ছোট, তাদের দায়িত্ব পড়ত বেগারের দাদা-চাচাদের বিশ্রামের জলখাবার পিঠা, গুঁড়-মুড়ি, খই মাঠে দিয়ে আসার।

 

দুপুরের প্রখর রোদের মধ্যে গাছের ছায়ায় ঝিরঝিরে বাতাসে পরিশ্রান্ত শরীরকে এলিয়ে দিয়ে আয়েশ করে মুড়ি খাওয়ার যে কী আনন্দ, তা অন্য কিছুতে পাওয়া যাবে না। এরপর গ্রামের বাজারের সাপ্তাহিক হাটের দিন দাদা তাদের রাতে খাওয়ার দাওয়াত দিতেন। সেদিন বাড়িতে উৎসব উৎসব ভাব লেগে থাকত। মানুষের মধ্যে সেই হৃদ্যতা আজ কোথায়?

 

আমি বা আমার মতো বয়সি, যারা গ্রামে বড় হয়েছে, তারা সত্যিই সৌভাগ্যবান। আমাদের সামনে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ ছিল। বন্ধনহীন শৈশব, কৈশোরে আমরা মাঠের পর মাঠে ছুটে বেড়িয়েছি। পাখি তাড়াতে তাড়াতে, আর ঘুড়ির পেছনে ছুটতে ছুটতে কত দুপুর কেটেছে, তার ইয়াত্তা নেই। কতবার যে মায়ের বকুনি, বাপ-চাচার শাসন উপেক্ষা করে সমবয়সিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কপোতাক্ষ নদ সাঁতরে পার হয়েছি। ঝুমবৃষ্টির মধ্যে মাঠে দল বেঁধে ফুটবল খেলে যে আনন্দ পেয়েছি, তা আজ আমার জীবনের অমূল্য স্মৃতি। তবে জীবনের সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি বৈশাখী মেলা ঘিরে।

 

আমার সেই নিভৃত পল্লির সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলোর দৈনন্দিন জীবনে ছন্দপতন হওয়ার মতো কিছু সারা বছর ঘটত না। উৎসব বলতে বছরের দুটি ঈদ। ঈদে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ঠিকঠাক পালন করা হলেও গ্রামের ঈদগা ময়দান ঘিরে মেলা বসেনি কখনো। ব্যতিক্রম ছিল শুধু বৈশাখী মেলা। আমাদের ছোটদের কাছে বৈশাখী মেলা ঘিরে আনন্দের সীমা ছিল না। বৈশাখী মেলার মাস খানেক আগে থেকে চলত প্রস্তুতি। এবারের মেলা থেকে কী কিনব। গতবারের পিস্তলটা ভালো ছিল কি না? এবার একটা বন্দুক কিনতে হবে। কোন বলটা কিনতে হবে? সমবয়সিরা কে কী কিনবে বলে ঠিক করে রেখেছে, তা নিয়ে চলত আলোচনা। তর্কাতর্কিও। মেলা সামনে রেখে পরিকল্পনা-আলোচনায় আনন্দে কাটত দিনগুলো।

 

আমার গ্রামটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে হলেও গ্রামের মাঝখানে প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ, ডাকঘর রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ঘিরে রয়েছে একটি বিশাল খেলার মাঠ। এই মাঠে বৈশাখের প্রথম দিন অর্থাৎ নববর্ষে মেলা বসে। খুব সাদামাঠা। জৌলুস বা চাকচিক্য নেই সেই মেলায়। কিন্তু ছিল প্রাণের স্পন্দন। গ্রামের সব বয়সি মানুষ সেই মেলায় আসত। সবার সঙ্গে দেখা, ভাবের আদান-প্রদান হতো। কেনাকাটা করত সাধ্যমতো। মেলায় প্রচুর মিষ্টি বিক্রি হতো।

 

মেলাকে ঘিরে আমার ফুফাতো-মামাতো-খালাতো ভাইবোনেরা কয়েক দিন আগে আমাদের বাড়ি এসে হাজির হতো। ছোটদের জন্য এটা ছিল বাড়তি পাওনা। সারা বছর এই সব ভাইবোনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই, কিন্তু বৈশাখী মেলার আগে ঠিকই এসে হাজির। নববর্ষের দিনে সকালে পুকুর থেকে মাছ ধরা হতো। বড়দের সঙ্গে আমরাও নেমে পড়তাম পানিতে। মাছ হয়তো ধরতে পারতাম না কিন্তু আনন্দ উপভোগ করতাম। এরপর শুরু হতো মাঝে মাঝে মেলা ঘুরে আসা। মেলা পুরোপুরি জমত বিকেলে। কারণ গ্রামের বড়রা দুপুরের রোদটা একটু পড়ে এলে মেলায় যেতেন। আর তখন তারা আমাদের আবদার মেটাতেন। আবদারের তালিকা যেন ছোট না হয়ে যায় সেজন্য সকাল থেকে শুরু হতো আমাদের অভিযান। বিকেলের আগে কয়েকবার মেলায় গিয়ে কোন দোকান এল, আর পছন্দের কী উঠল, তা দেখে দেখে ঠিক করে রাখতাম। আমাদের সেই আবদার খুব বেশি ছিল না, পূরণ করতে বাবা-চাচাদের তেমন সমস্যাও হতো না, কিন্তু সেই সাদামাঠা কয়েকটি খেলনায় যে আনন্দ আমরা পেতাম, তা তুলনাহীন।

 

আজ আমার সেই গ্রাম থেকে অনেক দূরে থাকি। প্রায় প্রতিবারই বাংলা একাডেমির সামনের পাকা রাস্তার বৈশাখী মেলায় যাই। বিশাল মেলা। আমার গ্রামের সেই মেলার চেয়ে বহু গুণ বড়। এখানে মানুষের সমাগম ঘটে হাজার হাজার। বেচা-বিক্রি হয় ব্যাপক। প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায় এখানে। রং-বেঙের বৈশাখী পোশাকে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, সুন্দরী-রূপসীরা ভিড় জমায়। এত জৌলুস-চাকচিক্যের মধ্যেও কী যেন খুঁজে ফিরি। গ্রামের মেলার মানুষের সেই প্রাণের স্পন্দন এখানে পাইনে। মানুষে-মানুষে প্রাণের টান অনুভাব করে না। মানুষগুলো সব অচেনা।

 

শৈশবে বাবা-চাচার কাছে বায়না ধরে একটা পিস্তল আদায় করতে পেরে যে আনন্দ পেয়েছি, আজ কারো কাছে বায়না ধরতে হয় না, শতটা পিস্তল ঢাকার পিচঢালা রাস্তার মেলা থেকে অনাসয়ে কিনতে পারি, কিন্তু সেই আনন্দ পায় না।

       

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ এপ্রিল ২০১৫/বকুল/কমল কর্মকার